Header Ads

Header ADS

অবিলিঙ্ এন্ড কোং : কল্লোল মোস্তফা


খ্রিস্টপূর্ব ৫০ সনের কথা। রোমানরা গলদের প্রায় পুরো এলাকা দখল করে নিয়েছে_শুধু ছোট্ট একটি গ্রামকে কিছুতেই দখল করতে পারছে না। সব ধরনের সামরিক প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর সম্রাট সিজার ভাবলেন, এবার একটু অন্যভাবে চেষ্টা করা যাক। সে জন্য তিনি লাতিন স্কুল অব ইকনোমিঙ্রে পন্ডিত প্রিপস্টারাসকে ডাকলেন-যদি তার কাছ থেকে কোন বুদ্ধি পাওয়া যায়।
সিজার প্রিপস্টারাসকে বললেন, দেখ পন্ডিত এই গলরা ভীষণ শক্তিশালী। এদের একতাবোধ খুব বেশি। নিজেদের মাঝে কোন ঝগড়া বিবাদ নেই। খাবার-দাবার, ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে কোন প্রতিযোগিতা নেই_যার যা প্রয়োজন নিজেরাই তৈরি করে নেয়, আর নিজেরা যা তৈরি করতে পারেনা, তা অন্যদের সাথে বিনিময় করেই পেয়ে যায়। ফলে আমাদের সৈন্যরা এদেরকে কিছুই করতে পারছে না। প্রিপস্টারাস সব শুনে বললেন, ' এই ব্যাপার। তো খুব সহজ কাজ। আপনি আমাকে কিছু স্বর্ণমুদ্রা দিন তারপর দেখুন গলদের নিয়ে কি করি আমি।'
গলদের মাঝে এক দারুণ শক্তিশালী ব্যক্তি ছিলেন। তার নাম অবিলিঙ্। তার কাজ ছিল 'মেনহির' তৈরি করা (আমরা ঠিক জানি না সেই সময়ে ঠিক কি কাজে গলরা মেনহির ব্যবহার করত!) দিনে কোন রকমে একটা মেনহির তৈরি করেই তিনি ছুটতেন তার শখের শিকারে। বন্য শুকর শিকার ছিল তার নেশা। তো, প্রিপস্টারাস এই অবিলিঙ্রে পিছনে লাগল। একদিন অবিলিঙ্ বিশালকার এক মেনহির কাঁধে নিয়ে অনেকটা দুলকি চালে বনের পথ দিয়ে যাচ্ছিল। প্রিপস্টারাস তখন এক মেনহির ব্যবসায়ীর ছদ্মবেশে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়_
'
ইস! কি দারুণ সুন্দর জিনিস তোমার পিছনে।'
'
আমার পিছনে!' অবিলিঙ্ বেশ আশ্চর্য হয়।
'
হঁ্যা, তোমার পিঠের ওই অসাধারণ মেনহিরটা তুমি কোত্থেকে পেলে?' পন্ডিত এমন একটা ভাব করল যেন সে কিছুই জানে না।
'
, ওটা। ওটাতো আমি নিজেই বানিয়েছি।'
'
বিক্রি করবে ওটা আমার কাছে? দুইশ স্বর্ণমুদ্রা দেব।'
অবিলিঙ্ বলে, 'স্বর্ণমুদ্রা! স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে আমি কি করব?'
ধূর্ত প্রিপস্টারাস তখন তাকে বোঝায় স্বর্ণমুদ্রা কত ভাল জিনিস! স্বর্ণমুদ্রা থাকলে যা চাওয়া যায়, তাই পাওয়া যায়। বলে, 'স্বর্ণমুদ্রা থাকলে তুমি হবে গ্রামের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি অর্থাৎ সবচেয়ে ক্ষমতাবান।'
এবার অবিলিঙ্ একটু আগ্রহ নিয়ে তাকায়। সুযোগ বুঝে প্রিপস্টারাস তাকে কিছু রোমান চিত্রকর্ম দেখায় যেখানে দেখা যায় ধনী ব্যক্তিরা সুন্দর সুন্দর পোশাক পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদেরকে ঘিরে আছে সুবেশী নারী-পুরুষ-সবাই ধনী ব্যক্তিদের তোষামোদ করছে। এরকম আরো অনেক ছবি দেখিয়ে গল্প করে প্রিপস্টারাস এক সময় অবিলিঙ্কে স্বর্ণের বিনিময়ে মেনহির বিক্রি করতে রাজি করিয়ে ফেলে।
অবিলিঙ্ এখন গ্রামের সবচেয়ে 'সম্মানিত' ব্যক্তি! অর্থাৎ তিনি শিকার-টিকার বাদ দিয়ে সারাদিন শুধু মেনহির তৈরি করেন। যত বেশি মেনহির তত বেশি স্বর্ণমুদ্রা। যতবেশি স্বর্ণমুদ্রা, ততবেশি সম্মান, ততবেশি ক্ষমতা, ততবেশি সুখ। ফলে অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে, বন্ধুদের সময় দেয়া, তাদের সাথে গানবাজনা করা তো দূরের কথা নিজের খাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় শুকরটা পর্যন্ত তিনি শিকার করতে পারেন না। লোক
নিজের খাদ্য সমস্যা সমাধানের জন্য তিনি এনালজেসিঙ্কে গ্রামের দ্বিতীয় "ধনী" ব্যক্তিতে পরিণত করেন, অর্থাৎ এনালজেসিঙ্ এখন অবিলিঙ্রে জন্য শূকর শিকারে ব্যস্ত থাকে যার বিনিময়ে অবিলিঙ্ তাকে কিছু স্বর্ণমুদ্রা দেন।
এদিকে প্রিপস্টারাস কিন্তু বসে নেই। অবিলিঙ্কে তাড়া দেয় 'উৎপাদন' বাড়ানোর জন্য_ অবিলিঙ্ যদি আরো বেশি করে মেনহির তৈরি না করে তবে 'বাজারের পতন' ঘটবে ইত্যাদি ইত্যাদি। বাজার জিনিসটা ঠিক কি, এটা কি খায় না মাথায় দেয়_সেটা না বুঝলেও কিছুটা প্রিপস্টারাসের তাড়া আর কিছুটা আরও বেশি ধনী হওয়ার বাসনায় অবিলিঙ্ এবার এনালজেসিঙ্কেও মেনহির বানানোর কাজে নিয়োগ করেন।
আর তাদের খাদ্য শিকার করার জন্য ভাড়া করা হল অন্য দু'জন লোককে। শ্রীঘ্রই নতুন দু'জনও মেনহির তৈরির কাজে লেগে গেল। আর শিকারের জন্য গ্রামের নতুন চারজনকে ভাড়া করা হল। এভাবে প্রক্রিয়াটি বেড়েই চলল।
কিন্তু যে শুকর একসময় ছিল গ্রামের সবার সাধারণ সম্পত্তি, অর্থাৎ যে শিকার করতে পারে সেই শুকর ধরে খেতে পারত সেটা নিয়ে এখন শিকারীদের নিজেদের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা শুরু হল। শুধু তাই নয়, গ্রামের অন্যান্য অধিবাসীরা শখ করে শিকার করতে এলে তারা বাধা দেয়া শুরু করল। কেননা এতে তাদের শিকারে ব্যাঘাত ঘটে, অর্থ উপার্জনও যায় কমে।
এই যখন অবস্থা, প্রিপস্টারাস আবার একটা চাল চালল। দারুণ একটা পার্টি দিয়ে সেখানে অবিলিঙ্কে বলল, 'আপনি এখন গ্রামের সবচেয়ে সম্মানিত লোক, আপনার কি আর সবার মতো সাধারণ পোষাক পরা মানায়!_ আপনাকে ব্যবসার প্রয়োজনেই এবার স্মার্ট হতে হবে।' ঘটনার পর যেদিন ফেরিওয়ালা তার শুকরের গাড়িতে করে বিনিময়ের জন্য কাপড় নিয়ে এলো, অবিলিঙ্ সেদিন প্রচুর অর্থ দিয়ে কাপড়-চোপড়সহ শুকুরের গাড়িটা কিনে ফেললেন। ফেরিওয়ালা এখন তার মেনহির শ্রমিকে পরিণত হল আর সেই গাড়ীতে করে বেশি বেশি মেনহির একবারে সরবরাহ করা সম্ভব হল। ওদিকে গ্রামের নারী যারা অর্থের অভাবে কোন নতুন কাপড়ই কিনতে পেল না, তারা তাদের স্বামীদের দারিদ্রের জন্য অভিযুক্ত করল। গ্রেটারিঙ্ নামে এক ব্যক্তির স্ত্রী তো একেবারে অবিলিঙ্রে প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়ল। অবিলিঙ্রে জন্য প্রয়োজনীয় পোশাক বানানোর একটা কাজও সে পেল।
এদিকে অবিলিঙ্রে এক বন্ধু ছিল এসর্টেরিঙ্। সে দারুণ বুদ্ধিমান। সব দেখে শুনে সে কিন্তু প্রিপস্টারাসের ষড়যন্ত্রটা অাঁচ করতে পেরেছিল। দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা! এই বলে সে অনেককে মেনহির বানানোর কৌশলটা শিখিয়ে দিয়ে বলল, তাহলে তোমরাও অবিলিঙ্রে মতো হতে পারবে। এরপর অবস্থা এমন হল যে গ্রামের অর্ধেক লোক পরস্পরের সাথে মেনহির বানানোর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হল। আর বাকি অর্ধেক লোক শুকর শিকারের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হল। প্রতিদ্বন্দ্বী দেখে অবিলিঙ্ একটু ভড়কে গেলেন। প্রিপস্টারাস কিন্তু সবাইকে স্বাগত জানাল এবং উঁচু মূল্যে মেনহির কিনে মেনহিরের এক পাহাড় বানিয়ে ফেলল। কিন্তু এই মেনহির দিয়ে তিনি কি করবেন? রোম সাম্রাজ্যে তো এর কোন ব্যবহারিক মূল্য নেই, কি বলে এটা বিক্রি করবেন? বিক্রি না করলে তো চলবে না। কেননা এর মধ্যেই মেনহির কিনে কিনে রাজভান্ডার প্রায় উজাড়। অনেক শলা-পরামর্শের পর একটা বুদ্ধি তারা ঠিক করলেন। (এই বর্বর ব্যবসাবৃত্তির সাথে যারা পরিচিত নয়, তাদের পক্ষে এর পরের ঘটনাকে হৃদয়াঙ্গম করতে বেশ কষ্ট হবে। কেননা আজকের দিনে কেউ এটা স্বপ্নেও ভাবতে পারবে না যে এরকম একটা নিতান্তই অপ্রয়োজনীয় জিনিস কেউ এভাবে বিক্রি করতে পারে!) এমন
তারা ভেবে দেখলেন, মানুষ কেনে_ () প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র () আরাম-আয়েশের জিনিসপত্র () আনন্দ করার জিনিসপত্র () এমন কিছু যা তাদের কাছে থাকলে প্রতিবেশীরা ঈর্ষান্বিত হবে অর্থাৎ চৎবংঃরমব বাড়বে।
যারা এই শ্রেণীর জিনিস কেনে এমন লোককের টার্গেট করে ব্যাপক প্রচারণা শুরু করলো। বিজ্ঞাপনগুলো সুন্দর ছবিসহ দেয়ালে দেয়ালে শোভা পেতে লাগল:
আপনার প্রিয়তম বাসনা-
একটা মেনহির।
এটা বিরাট, এটা সুন্দর
-
এর নাম মেনহির।
আপনার একটা প্রাসাদ আছে,
একটা রথ আছে,
অসংখ্য দাস আছে-কিন্তু
একটা মেনহির আছে কি?
এমনকি থিয়েটারগুলোতে বিরতির সময় চলতে লাগল মেনহিরের গুণকীর্তন। ফলাফল এলো দ্রুত। 'হট-কেকের' মতো বিক্রি হতে লাগল মেনহির। শুধু মেনহির নয়, মেনহিরকে ভিত্তি করে আরো অনেক ধরনের জিনিসপত্র রোমের বাজারে সয়লাব হয়ে গেল। মেনহিরের লোগো অাঁকা কাপড়-চোপড়, মেনহির আঁকা লকেটযুক্ত গহনা-গাঁটি থেকে শুরু করে মেনহির পরিচর্যার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি পর্যন্ত বিক্রি হতে লাগল।
ঘটনা এখানেই শেষ হয় না। সিজার এবং প্রিপস্টারাস যখন পরামর্শ করেছিলেন যে, মেনহির ব্যবসা বাড়ানোর জন্য মেনহিরকে ক্ষণস্থায়ী করে বানানো দরকার, তা না হলে তো একবার বিক্রি হবার পর আর বিক্রি হবে না। ফলে তাদের ব্যবসাও লাটে উঠবে। তখন দূত এসে জানাল যে, দেয়ালে দেয়ালে একটি নতুন বিজ্ঞাপন শোভা পাচ্ছে।
আসল রোমান মেনহির কিনুন
আমদানীকৃত মেনহিরের চেয়ে সস্তা!!
-
মেরিট্রিসিয়াস, মেনহির প্রস্তুতকারক
সিজার তৎক্ষণাৎ মেরিট্রিয়াসকে তলব করে ধমক দিয়ে বলল, "বন্ধ কর এই রোমান মেনহির কারখানা।" মেরিট্রিসিয়াস বললেন, "আমি সমস্ত মেনহির শিল্পের প্রতিনিধিত্ব করছি। আমার পক্ষে এমন কোন নিষেধাজ্ঞা মেনে চলা সম্ভব নয় যা আমার হাজার হাজার শ্রমিককে বেকার করে দেবে।"
"
কিন্তু ওই শ্রমিকরা তো কেবল দাস! তাদের জন্য তোমার এত দরদ কেন?"
"
দাস বলেই তো এত দরদ! শুধু কাজ করার অধিকারই হচ্ছে একজন দাসের একমাত্র অধিকার। তাকে এই অধিকারটুকু থেকে বঞ্চিত করা ঠিক হবে না।' এরপর আলোচনা ভেঙ্গে যায়। মেরিট্রিসিয়াসের মদদে বিদেশী গলদের তৈরি মেনহির নিষিদ্ধ করার আন্দোলন শুরু হয়। রোমান সম্রাট মেনহির বানানোর অনুমতি দিতে বাধ্য হয়। এরপর শুরু হয় আরেক বিপদ। গ্রীক, মিশরীয়, ফিনিশীয়_ইত্যাদি নানান দেশী নানান ধরনের রঙের মেনহির সুন্দর সুন্দর শপিং সেন্টারে থরে থরে সাজানো-কিন্তু কেনার লোক নেই। তাই দেয়ালে দেয়ালে দেখা গেল নতুন ধরনের বিজ্ঞাপন-
মূল্যহ্রাস! মূল্যহ্রাস!
গলিশ মেনহিরের
৫০% মূল্যহ্রাস
রোমান মেনহির!
একটির দামে দুটো নিন
আরো বড়
আরো ভালো! আরো সস্তা!
সুপার ডিলাঙ্
রোমান মেনহির!
গলিশের মেনহির কিনুন!
বিনামূল্যে দুটো দাস নিন
স্টক সীমিত!
মেনহিরের যে বাজার এক সময় চড়া ছিল হাজার চেষ্টা করেও তা ধরে রাখা গেল না। সম্রাটের থাতানি খেয়ে প্রিপস্টারাস গলদের কাছ থেকে মেনহির কেনা বন্ধ করে দিল। ফলে গলরা একবারে ভেঙ্গে পড়ল। তারা অবিলিঙ্কে এসবের জন্য দায়ী করল, কেননা তারা আগে যার যার প্রয়োজনীয় জিনিস নিজেরা তৈরি করে বেশ সুখেই ছিল_অবিলিঙ্ই তো স্বর্ণমুদ্রার লোভে বেশি বেশি মেনহির তৈরী করতে গিয়ে বিপত্তি বাঁধাল। তখন বুদ্ধিমান এসটেরিঙ্ তাদেরকে আসল ব্যাপারটা ধরিয়ে দিল। আর যায় কোথায়! সব বিভেদ ভুলে সেই আগের মতো তারা ঝাঁপিয়ে পড়ল দখলদার রোমানদের উপর।

No comments

আমাদের ঠিকানা

রংপুর।, Bangladesh
বিজ্ঞানচেতনা পরিষদ, টাউন হল চত্বর, রংপুর। মোবাইলঃ ০১৭১৯৪৬৩৫৪১, ০৭১৪৬০৭০৬৩৪, ০১৭৩৮২৮০২০১। E-mail: muktochintabcp@gmail.com
Powered by Blogger.