আমাদের রোকেয়া পাঠ / অনামিকা দেবগুপ্ত
আজ আর নারী অবরোধবাসী নয়। পুরুষের মতো তারা ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। রাষ্ট্র পরিচালনা থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রশাসনিক কর্মকান্ডে, শিল্পকারখানার শ্রমিক, কৃষিকাজে, ব্যবসার উদ্যোক্তা এবং বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত হয়েছে নারী। নারীর এগিয়ে চলার পথ আজও মসৃন নয়। নারী আজও পারিবারিক ও সামাজিক বাধার সম্মুখীন হচ্ছে এবং বাধাকে অতিক্রম করে এগিয়ে যাচ্ছে। নারী-পুরুষের কাজের বৈষম্য কমে এলেও নারী শিকার হচ্ছে মজুরি বৈষম্যের। এখনও নিশ্চিত হয়নি সম্পত্তিতে সমান অংশীদারিত্ব।
নারী-পুরুষের বাহিরের কাজে বৈষম্য কমলেও রয়েছে ঘরের কাজে বৈষম্য। সন্তান পালন, রান্নার কাজ, কাপড়-চোপড় পরিস্কার ইত্যাদি কাজের দায়িত্ব পালন করতে হয় নারীকে, অন্যদিকে সংসার চালানোর দায়িত্ব পুরুষের। আবার নারীকে হতে হবে নরম, কোমল ও সুন্দরী (ফর্সা/সাদা রংয়ের অধিকারী)। দাসত্বসূচক অলঙ্কারে ভূষিত হয়ে যে যত নিপুনভাবে নিজেকে অপরূপ হিসেবে সাজাতে পারবে সেই নারী পুরুষের মনোরঞ্জনের জন্য তত উপযোগি। নারী চায় তার পুরুষ সঙ্গিটির পেশাগতযোগ্যতা হবে তার পেশা থেকে উচু পর্যায়ের, জানবে তার থেকে বেশি, লম্বায় অবশ্যই হবে তার থেকে উচু।
বোঝা যাচ্ছে যে, নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জিত হলেও মানসিক দাসত্বের শৃঙ্খলে সে আজও শৃঙ্খলিত।
কিন্তু, কেন নারীর এই হীনমন্যতা? কেন নিজেকে মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত না করে ‘ভোগ্যপণ্য’ হিসেবে উপস্থাপন করা?
আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগে রোকেয়া পুরুষতন্ত্র, ধর্মীয় শৃঙ্খল, শ্রেণিশোষনকে সম্মিলিতভাবে দেখেছেন ও তা লেখার মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। নারীর পশ্চাৎপদতা, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কারাচ্ছন্নতা, দাসত্বের কারণ অনুসন্ধান করেছেন এবং সেই সাথে পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও ধর্মের বিধানের স্বরূপ উন্মোচন করেছেন। অন্যদিকে আত্মসম্মান বোধহীন নারীকে করেছেন আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত। নারীকে আহ্বাণ জানিয়েছেন, ‘মানুষ’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার, পুরুষের মনোরঞ্জনের জন্য। ‘ভোগ্যপণ্য’ হিসেবে নয়। অথচ আজও রোকেয়ার চেতনা ধারন ও চেতনাকে বিকশিত করতে পারেনি নারী। কিন্তু কেন?
বলা হয়ে থাকে শিক্ষা মানুষের অন্তনির্হিত গুণ ও সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে তাকে বুদ্ধি, বিবেক, মেধা-মনন, যুক্তি, জ্ঞান-বিজ্ঞানে পরিপূর্ণ একজন মানবিক মানুষরূপে গড়ে তোলে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় যে শিশুটি প্রবেশ করে সে তখন নিতান্তই একটি শিশু, অগঠিত মানব সন্তান। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট পঠন-পাঠনের মাধ্যমে মেধামননে ও সৃজনশীলতার মানবসমাজ বান্ধব একজন প্রগতিশীল মানুষে পরিণত হওয়ার শিক্ষা ও দীক্ষা দেয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নির্দিষ্ট পঠন-পাঠনের মধ্যে দিয়ে আমরা রোকেয়াকে কিভাবে জানছি? রোকেয়া পাঠের মধ্যে দিয়ে শিশুর কিরকম দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হচ্ছে? ‘মুক্তচিন্তা গবেষণা সেল’ তা বুঝতে চায়, বিশ্লেষণ করতে চায় এবং প্রশ্ন করতে চায়। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকের বিভিন্ন বিষয়ের বইয়ে রোকেয়া পাঠের বিশ্লেষণ আমরা এই বিভাগে প্রকাশ করব।
এবারের বিষয়ঃ পঞ্চম শ্রেণির পরিবেশ পরিচিত সমাজ, অধ্যায় চৌদ্দ
[বিঃদ্রঃ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঠিত বিষয়ের অন্য কোন পাঠে রোকেয়া পাঠ অর্ন্তভুক্ত করা হয় নি]
পরিবেশ পরিচিতি সমাজ, পঞ্চম শ্রেণি ভূমিকায় বলা হয়েছেঃ
........... প্রথমিক স্তরের শিক্ষাক্রমে ৫ম শ্রেণির “পরিবেশ পরিচিতি: সমাজ” বিষয়ের জন্য চিহ্নিত শ্রেণি ভিত্তিক অর্জনোপযোগী যোগ্যতার ভিত্তিতে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, ঢাকা কর্তৃক নির্বাচিত এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষ মন্ত্রনালয় কর্তৃক অনুমোদিত লেখকগণ পঞ্চম শ্রেণির জন্য “পরিবেশ পরিচিতি: সমাজ” পাঠ্যপুস্তক রচনা করেন। জাতীয় কর্মশালার মাধ্যমে শ্রেণিশিক্ষক, শিক্ষক প্রশিক্ষক, বিষয় বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞের সহায়তায় ৪দিন ব্যাপী বইটির যৌক্তিক মূল্যায়ন সম্পন্ন করা হয়। অতঃপর প্রফেশনাল কমিটি কর্র্তৃক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মূখ্য সচিব মহোদয়ের সভাপতিত্বে গঠিত জাতীয় সমন্বয় কমিটির সদস্যগণের মাধ্যমে পুনরায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যালোচনার পর উক্ত কমিটি পুস্তকটির চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়।
পঞ্চম শ্রেণির পরিবেশ পরিচিতি সমাজ বইয়ে সমাজ সেবায় বরেণ্য ব্যক্তিত্ব। শিরোনামে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও রোকেয়ার জীবনীর সং্িক্ষপ্তভাবে আলোচনা করা হয়েছে। ভুল, বিকৃত, ব্যাখ্যাহীন তথ্যের মধ্যে দিয়ে পাঠটি রচিত হয়েছে। অপরদিকে পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে রোকেয়াকে খন্ডিত রূপে উপস্থাপন করা হয়েছে।
প্রশ্নজাগে, জাতীয় কর্মশালার মাধ্যমে শ্রেণিশিক্ষক, শিক্ষক প্রশিক্ষক, বিষয় বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞের সহায়তায় ৪দিন ব্যাপী বইটির যৌক্তিক মূল্যায়ন কিভাবে সম্পন্ন করা হয়েছে?
প্রফেশনাল কমিটি কর্র্তৃক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মহোদয়ের সভাপতিত্বে গঠিত জাতীয় সমন্বয় কমিটির সম্মানিত সদস্যগণের মাধ্যমে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যালোচনা হয়েছিল কোন পদ্ধতিতে? ভূমিকায় আরো বলা হয়েছে............ “সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সযতœ প্রয়াস ও সতর্কতা সত্ত্বেও পুস্তকটিতে কিছু ত্র“টি-বিচ্যুতি থেকে যেতে পারে। পরবর্তী সংস্করণে পাঠ্যপুস্তকটি ত্র“টিমুক্ত করার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। অথচ অক্টোবর ২০০৫, পরীক্ষামূলক সংস্করণ ও অক্টোবর ২০১০ এর পাঠ্যবইয়ে রোকেয়া পাঠটির কোন পরিবর্তন করা হয় নি। প্রশ্নজাগে, তাহলে কি ভুল, বিকৃত তথ্যের মধ্যে দিয়ে বিভ্রান্ত করা, রোকেয়াকে খর্বিত করা ও পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন উত্তরসূরী তৈরি করাই তাঁদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য?
এবার পাঠের ভুল, বিকৃত, ব্যাখ্যাহীন তথ্যগুলোর বিশ্লেষণ ও উক্ত পাঠে উপস্থাপনের উদ্দেশ্য নিয়ে আলোচনা করা যাক।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও রোকেয়ার জীবনী আলোচনা শুরু করার ভূমিকাতে লেখা আছে “মানুষের সেবা করার জন্য আমাদের মধ্যে অনেক মহান মানুষ জন্মগ্রহন করেছে। মানবতাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে তাঁরা দুস্থ, দরিদ্র, অসহায়, অসুস্থ, দীন দুঃখী মানুষের কল্যাণে এগিয়ে আসেন।”
উপরের অংশটি কোমলমতি শিশুরা পড়ে মনে করবে মহানরা জন্মগ্রহণ করেন মহান হিসেবে। অথচ শিশুদের জানানো প্রয়োজন মহান হিসেবে কেউ জন্মগ্রহণ করে না। চারপাশের পরিবেশ, সমাজের ঘাত-প্রতিঘাত সমাজিক চিন্তার মধ্য দিয়েই মানুষ মহানরূপে তৈরি হয়।
আবার শিশুরা মনে করবে দুস্থ, দরিদ্র, অসহায়, দীন-দুঃখী, মানুষদের অর্থ দিয়ে সাহায্য ও অসুস্থ মানুষদের শুশ্রƒষা যারা করেন তারাই মহান।
যারা সমাজের পশ্চাৎপদতা, কুসংস্কার, কূপমণ্ডুকতা, ধর্মান্ধতা, দাসত্বের কারণ অনুসন্ধান ও দূরীকরণের জন্য কাজ করেন। অন্যায়, অত্যাচার, অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন এবং যারা মানবিক সমাজ নির্মাণে কাজ করেন তাদের পরিচয় কি?
মাদার তেরেসা, ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল, রোকেয়া, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এদের সবার কাজের প্রকৃতি কি একই?
তাহলে পাঠে ব্যাখ্যাহীন ও বিভ্রান্তিকর তথ্য দেয়া হল কেন? ব্যাখ্যাহীন ও বিভ্রান্তিকর তথ্যের মধ্যে দিয়ে জিজ্ঞাসাহীন, প্রতিবাদহীন, উত্তরসূরী তৈরি করাই কি তাঁদের উদ্দেশ্য?
এরপর ‘বেগম রোকেয়া’ শিরোনাম দিয়ে রোকেয়ার জীবনীর আলোচনা শুরু করা হয় এবং একটি বাক্যে লেখা আছে “তাঁর পুরো নাম বেগম রোকেয়া আর ডাক নাম রুকু”।
পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজে বিয়ের পর নারীর নামের সাথে বেগম ও অর্ধাঙ্গের নামের অংশ যুক্ত হয় নারীর নিজস্ব সত্ত্বাকে অস্তিত্বহীন করার জন্যে। রোকেয়া বিষয়টি বুঝতে পারলেও তৎকালীন প্রেক্ষাপটে তাঁর নামের শেষে সাখাওয়াত হোসেন যুক্ত করেছিলেন আর বাদ দিয়েছিলেন বেগম অংশটি। বেগম শব্দটি বাদ দেয়ার ফলে তাঁকে বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। দুক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার ‘কোহিনুর পত্রিকায়’ লেখেন, “গ্রন্থরচয়িত্রীর নামের পূর্বে, মিসেস, সংযোগ দেখিয়া পাশ্চাত্য অনুরাগ আছে তাহা বুঝিলাম।” (রোকেয়া রচনাসমগ্র, বাংলা একাডেমী, পৃষ্ঠ- ৫৭৫)
এরপরও রোকেয়া ‘বেগম’ শব্দটি তাঁর নামের পূর্বে সরাননি। অথচ আমাদের পাঠ্যবই রচয়িতারা রোকেয়াকে ‘বেগম রোকেয়া’ হিসেবে পরিচয় দানে বদ্ধ পরিকর। পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজে নারীর নামের সামনে ‘বেগম’ শব্দটি না বসালে যেন পৌরুষে বাধে। রোকেয়া তাঁর নামের সামনে ‘বেগম’ শব্দটি বাদ দিলেও রোকেয়াকে ‘বেগম রোকেয়া’ হিসেবে পরিচয় দানের মধ্য দিয়ে সমাজ পৌরষত্ব জাহির করে। ফলে রোকেয়ার পুরো নাম রোকেয়া খাতুন হিসেবে তুলে ধরা হয় নি। রোকেয়াকে নিজস্ব অবস্থান থেকে সরিয়ে পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোতে ঢুকিয়ে শিশুর পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা গঠন করাই কি এর উদ্দেশ্য নয়?
পাঠটির কিছু অংশ পড়ার পর শিশুরা পড়বে “লেখাপড়ার প্রতি তাঁর আগ্রহ বড়ভাইয়ের নজরে আসে। তিনি বোনকে লেখাপড়া শেখার কাজে সাহায্যে সহযোগিতা করতে থাকেন।”
শিশুরা পড়ে মনে করবে বড় ভাইয়ের সাহায্যে সহযোগিতায় রোকেয়া লেখা পড়া শিখেছে। কিন্তু রোকেয়ার লেখাপড়া শেখার কাজে বড় ভাইয়ের পাশাপাশি বড় বোন করিমুন্নেসার অবদান ছিল শিশুরা তা জানবে না। রোকেয়া মতিচুর (২য় খন্ড) করিমুন্নেসা কে উৎসর্গ করেন এবং উৎসর্গ পত্রে লেখেন। “আমি শৈশবে তেমারই স্নেহের প্রসাদে বর্ণপরিচয় পড়িতে শিখি। অপর আত্মীয়গণ আমার উর্দ্দু ফারসী পড়ায় তত আপত্তি না করিলেও বাঙ্গালা পড়ার ঘোর বিরোধী ছিলেন। একমাত্র তুমিই আমার বাঙ্গালা পড়ার অনুকূলে ছিলে। আমার বিবাহের পর তুমিই আশঙ্কা করিয়াছিল যে আমি বাংলা ভাষা একেবারে ভুলিয়া যাইব। চৌদ্দ বৎসর ভাগলপুরে থাকিয়া, বঙ্গভাষায় কথাবার্ত্তা কহিবার একটি লোক না পাইয়াও যে বঙ্গভাষা ভুলি নাই, তাহা কেবল তোমারই আশীর্বাদে। অতঃপর কলিকাতায় আসিয়া ১১ বৎসর যাবত এই উর্দ্দু স্কুল পরিচালনা করিতেছি। এখানেও সকলেই পরিচারিকা, ছাত্রী, শিক্ষয়িত্রী ইত্যাদি সকলেই উর্দ্দুভাষিনী। প্রাত:কাল হইতে রাত্রি পর্যন্ত উর্দ্দু ভাষাতেই কথা কইতে হয়। আবার বলি, এতখানি অত্যাচারেও যে বঙ্গভাষা ভুলিয়া যাই না, তাহা বোধ হয় কেবল তোমারই আশীবার্দের কল্যাণে।” রোকেয়া করিমুন্নেসার অবদানকে কৃতজ্ঞভাবে স্বীকার করলেও পাঠ্যবই রচয়িতারা করিমুন্নেসার অবদানের কথা শিশুদের জানানোর প্রয়োজন বোধ করেন নি। কারণ করিমুন্নেসা নারী। পুরুষতান্তিক সমাজে নারীর অবদানকে অস্বীকার/অবহেলার মধ্যদিয়ে ইতিহাসের আস্তাকুড়ে ফেলে দেয়াই প্রধান কাজ। ফলে তাঁরা করিমুন্নেসার অবদানকে পাঠের মধ্যে অর্ন্তভুক্ত করেন নি।
বিয়ের মাত্র নয় বছর পর সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের মৃত্যু হয়।
এর পর শিশু পড়বে “তাঁর ইচ্ছা ছিল ভাগলপুরে একটা মুসলিম বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা। বেগম রোকেয়া সেই স্কুলটির দায়িত্ব নেবেন। স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি কাজে নেমে পড়লেন।”
রোকেয়ার চিন্তার বিকাশ, যুক্তিবাদী ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছে চারপাশের পরিবেশ, সমাজের ঘাত-প্রতিঘাত, সামাজিক চিন্তার বিকাশের মধ্যদিয়ে। তাঁর চিন্তা হঠাৎ আকাশ থেকে পড়েনি। আর বড় ভাই, বোন, সাখাওয়াত হোসেন এবং আরও অনেকে তাঁর চিন্তার বিকাশ ও কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, রোকেয়া তাঁদের ইচ্ছাপূরণ করেছেন বা তাঁর কাজগুলো অন্যের ইচ্ছার প্রতিফলন। উপরের অংশটুকু পড়ে মনে হয় যে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের মৃত্যুর পর বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন সাখাওয়াতের ইচ্ছাপূরণের জন্য। অথচ মতিচূর (১ম খন্ড) প্রকাশ হয় ১৯০৪ সালে। এই গ্রন্থের বিভিন্ন প্রবন্ধে রোকেয়া সুশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার জন্য নারীদের আহবান জানিয়েছেন এবং ১৯০৫ সালে লেখা ‘সুলতানার স্বপ্ন’ নারীদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নেরর মধ্যে দিয়ে নারী মুক্তির স্বপ্ন দেখেন। এ রচনায় মহারানীর নারীর সুশিক্ষায় শিক্ষিত করার পদক্ষেপ গ্রহণ থেকে বোঝা যায় যে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন রোকেয়া দেখতেন। বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন যে তাঁর নিজের, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পাঠ্যবই রচয়িতারা জানলেও শিশুদের জানাতে চাননি। কেন? কারণ আজকের শিশু ভবিষ্যত পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কর্ণধার। ফলে তাদের শেখানো হচ্ছে নারীর নিজস্ব ইচ্ছা বলতে কিছু নেই। তারা শুধু পুরুষের ইচ্ছাপূরণের দাস!
এরপর শিশু পড়বে “তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন শিক্ষা ছাড়া নারী জাতির দুঃখÑদুর্দশা দূর হবে না।”
শিশু পড়ে মনে করবে দুঃখÑদূর্দশা দূর করাই শিক্ষার কাজ। অথচ রোকেয়া মনে করতেন নারীমুক্তি প্রশ্নে নারীর অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির জন্যে প্রয়োজন শিক্ষার। নারীর পশ্চাৎপদতা, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কারছন্নতা, দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন সুশিক্ষার। তিনি বোরকা প্রবন্ধে লিখেছেন “সম্প্রতি আমরা যে এমন নিস্তেজ, সঙ্কীর্ণমনা ও ভীরু হইয়া পড়িয়াছি, ইহা অবরোধে থাকার জন্য হয় নাই-শিক্ষার অভাবে হইয়াছে। সুশিক্ষার অভাবেই আমাদের হৃদয়বৃত্তিগুলি এমন সঙ্কুচিত হইয়াছে।”
আবার, ‘সুবেহ সাদেক’ প্রবন্ধে রোকেয়া লিখেছেন “শিক্ষা অর্থে আমি প্রকৃত সুশিক্ষার কথাই বলি; গোটা কতক পুস্তক পাঠ করিতে বা দু’ছত্র কবিতা লিখিতে পারা শিক্ষা নয়। আমি চাই সেই শিক্ষা-যাহা তাহাদিগকে নাগরিক অধিকার লাভে সক্ষম করিবে, তাহাদিগকে আদর্শ কন্যা, আদর্শ ভগিনী, আদর্শ গৃহিনী এবং আদর্শ মাতারূপে গঠিত করিবে।”
রোকেয়া যেখানে মানুষ হিসেবে নারীর অধিকার আদায় এর জন্য শিক্ষার কথা বলেন সেখানে পাঠ্যবই রচয়িতারা নারী জাতির দুঃখ-দুর্দশার দূর করার জন্য শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা ব্যাখ্যা করেন। হায়রে! কোথায় অধিকার আর কোথায় দুঃখ-দূর্দশার আবরণে মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম প্যাকেট বন্দী! শিশুর অনুসন্ধিৎসু মানসিকতা, অধিকার বোধ তৈরি না করাই কি এর উদ্দেশ্য? কয়েকটি লাইন পড়ার পর শিশু পড়বে, “নারী শিক্ষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তার কথা বলে তিনি বাড়ি বাড়ি ঘুরে ছাত্রী যোগাড় করার কাজে লেগে গেলেন। মেয়েদের মা বাবা ও অভিভাবকদের অনুরোধ জানালেন। মেয়েরা কঠোর পর্দা মেনে চলত বলে তিনি পর্দা ঘেরা গাড়ির ব্যবস্থা করেন। প্রথমে ঘোড়ার গাড়ি, পরে মোটর গাড়ি। আস্তে আস্তে স্কুলের ছাত্রী সংখ্যা বাড়তে থাকল। মা বাবা ও অভিভাবকরা মেয়েদের স্কুলে পাঠাতে আগ্রহী হয়ে উঠলেন।”
এই লাইনগুলো পড়ার পর শিশু মনে করবে রোকেয়া খুব সহজেই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করেছেন। আবার বিদ্যালয়ে শিশুর শতভাগ ভর্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচীর মধ্য দিয়ে শিক্ষার গুরুত্ব প্রচার করা হয়। শিক্ষকরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিভাবকদের সাথে শিক্ষার গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা মাধ্যমে শিক্ষার্থীর ভর্তির ব্যাপারে উৎসাহিত করেন এবং প্রচার মাধ্যমও শিক্ষার গুরুত্ব নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করে। ফলে শিশু রোকেয়ার কাজের সাথে এখনকার কর্মসূচীকে গুলিয়ে ফেলবে। কারণ তিনি সামাজিক বাধার সম্মুখীন হয়েছিলেন তার ব্যাখ্যা এখানে অনুপস্থিত। তৎকালীন সময়ে মেয়েদের লেখাপড়াকে সমাজ সমর্থন করত না। সেই চিন্তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে রোকেয়া বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করেন। ফলে তাঁকে কটুক্তি, অপমানজনক কথা ও সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়েছে। ‘অবরোধ-বাসিনী’ গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, “আর জীবনের ২৫ বৎসর ধরিয়া সমাজ সেবা করিয়া কাঠমোল্লাদের অভিসম্পাত কুড়াইতেছি।” এরপরও তিনি কাজ থেকে বিরত থাকেন নি। বরং তিনি একাগ্রতা নিয়ে দৃঢ়তার সাথে কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে সামাজিক বাধাকে উপেক্ষা করে বিদ্যালয় পরিচালনা করেন। ফলে ধীরে ধীরে ছাত্রীসংখ্যা বৃদ্ধি পায়। তাহলে ব্যাখ্যাহীন তথ্যে উপস্থাপন করা হল কেন?
প্রগতিশীল চিন্তার বিকাশ ও কাজে নিপীড়নমূলক নানা বাধা আসতে পারে সেই বাধাগুলোকে অতিক্রম করে কাজ করার জন্য চারিত্রিক দৃঢ়তা, একাগ্রতা ও লক্ষ্যে অর্জনের জন্য কাজ করার চেতনা যেন শিশুর মধ্যে তৈরি না করাই কি এর লক্ষ্য? এরপর শিশু পড়বে “বেগম রোকেয়া পড়ে মুসলিম নারীদের জন্য ‘মুসলিম ট্রেনিং স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে নারীদের সেলাই, রান্না, সন্তান, প্রতিপালনসহ বিভিন্ন বিষয় শেখানোর ব্যবস্থা ছিল।”
রোকেয়া কেন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলেন তার ব্যাখ্যা শিশুরা জানবে না? কারণ ব্যাখ্যাহীনভাবে তথ্যেটি প্রদান করা হয়েছে। নারী মুক্তির প্রশ্নে সাংস্কৃতিক মুক্তির সাথে সাথে অর্থনৈতিক মুক্তিরও প্রয়োজন। রোকেয়া তাই তৎকালিন সমাজ ব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে ‘মুসলিম মহিলা ট্রেনিং স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করেন। তৎকালিন প্রেক্ষাপটেই তিনি সেলাই, রান্না, সন্তান প্রতিপালন সহ বিভিন্ন বিষয় শেখানোর ব্যবস্থা করেন। নারীদের স্বাবলম্বী করতে রোকেয়া তৎকালীন সময়ের প্রেক্ষাপটে সেলাই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন, কিন্তু বর্তমানে যদি নারীদের স্বাবলম্বী করতে সেলাই প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যবস্থা করা হয় তবে তা হবে রোকেয়ার চিন্তার পরিপন্থী। ব্যাখ্যাহীন তথ্যে উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে শিশুদের বিভ্রান্ত করাই কি এর উদ্দেশ্য নয়?
এরপর শিশু পড়বে, “বেগম রোকেয়া নারী শিক্ষার প্রসারের জন্য কঠোর পরিশ্রম করেন। সেই সাথে তিনি সাহিত্য চর্চাও করেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য বই হচ্ছে: মতিচুর, সুলতানার স্বপ্ন, অবরোধবাসিনী ইত্যাদি। এসব বইয়ে তিনি মেয়েদের দুঃখ কষ্টের কথা লিখেছেন।”
তাঁর সাহিত্য যখন পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থাকে আঘাত করে, সাম্রাজ্যবাদী শাসনব্যবস্থার স্বরূপ ব্যাখ্যা করে, ধর্মের মীথকে ভেঙ্গে ইতিহাসের নতুন ব্যাখ্যা প্রদান করে, নারী মুক্তির কথা বলে, নারী-পুরুষের সম্মিলিতভাবে মানবিক সমাজ নির্মাণের কথা বলে তখন পাঠ্যবই রচয়িতারা তাঁর বইয়ে খুজে পান মেয়েদের দুঃখ-কষ্টের কথা। তাঁর লেখা প্রসঙ্গে ‘নারী, পুরুষ ও সমাজ’ বইয়ে আনু মুহাম্মদ লিখেছেন: সাম্রাজ্যবাদ, পুরুষতন্ত্র, ধর্মীয় শৃঙ্খল এবং শ্রেণী শোষণকে সমন্বিত করে দেখার অন্তর্দৃষ্টিও যে তিনি অর্জন করেছিলেন তা তাঁর বিভিন্ন লেখা থেকেই স্পষ্ট হয়। প্রচলিত বিশ্বাস মিথ ভাঙ্গা এবং নতুন মানবিক জীবনের কল্পনা গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও তিনি অসাধারণ ক্ষমতার পরিচয় দিয়েছেন।”
রোকেয়া আশা-জ্যোতি প্রবন্ধে স্ত্রীশিক্ষা বিরোধীদের মন্তব্য লিখেছেন। মন্তব্যটি হল: “আমরা পুরুষের রচনায় ইংল্যন্ডের সমাজের যত চিত্র না দেখিতে পাই, তাহা মহিলাদের রচনায় দেখিয়া থাকি।”
সেরকম “পাঠ্যবই রচয়িতারা রোকেয়ার লেখায় সাম্রাজ্যবাদ, পুরুষতন্ত্র, ধর্মীয় শৃঙ্খল, শ্রেণিশোষণের সমন্বিতরূপ দেখতে না পারলেও মেয়েদের দুঃখ-কষ্টকে বেশি দেখতে পান!”
শিশুর কাছে রোকেয়ার সাহিত্যেকে খন্ডিতরূপে উপস্থাপন করা হল কেন? শিশুর মধ্যে যেন তার চারপাশের পরিবেশ, সমাজের পশ্চাৎপদতা, কুসংস্কার, কূপমন্ডূকতা, শ্রেণিশোষণ, ধর্মান্ধতা নিয়ে যেন কোন প্রশ্ন না জাগে, যুক্তি ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে যেন বিশ্লেষণ না করে, তার চারপাশের পরিবেশ ধর্ম, সমাজ, শোষণকে খর্বিতভাবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করে তার জন্যই কি এই প্রচেষ্টা?
শিশুর কাছে রোকেয়ার কাজের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে এভাবে, “তাঁর কাজের জন্য তাঁকে ‘নারী জাগরণের অগ্রদূত’ বলা হয়।”
রোকেয়া বুঝেছিলেন যে, নারী-পুরুষের সম্মিলিত কাজই পারবে মানবিক সমাজ নির্মাণ করতে এবং বিভিন্ন লেখায় তিনি তা প্রকাশ করেছেন।
‘আশা-জ্যোতি’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, “সমাজের অর্ধাঙ্গ বিকল রাখিয়া উন্নতি লাভ করা অসম্ভব।”
আবার ‘স্ত্রী জাতির অবনতি’ প্রবন্ধে লিখেছেন, “আমরা সমাজের অর্ধাঙ্গ। আমরা পড়িয়া থাকিলে সমাজ উঠিবে কিরূপে? কোন ব্যক্তির এক পা বাঁধিয়া রাখিলে, যে খোঁড়াইয়া খোঁড়াইয়া কতদূর চলিবে? পুরুষদের স্বার্থ এবং আমাদের স্বার্থ ভিন্ন নহে-একই। তাঁহাদের জীবনের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য যাহা, আমাদের লক্ষ্যও তাহাই।” তাই নারী মুক্তি প্রশ্নে রোকেয়ার কাজ সমাজ অগ্রগতিতে ভূমিকা পালন করে।
আনু মুহাম্মদ তাঁর ‘নারী পুরুষ ও সমাজ’ গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন, “নারীপ্রশ্নকে একই সঙ্গে পুরুষপ্রশ্ন হিসাবেও অভিহিত করা যায়। আবার নারীপ্রশ্ন একই সঙ্গে সমাজ প্রশ্নও বটে। কেননা নারীপ্রশ্ন সমাজে, মনোজগতে পুরুষের অবস্থান এবং নারী-নারী, নারী-পুরুষ, এবং পুরুষ-পুরুষ সম্পর্কও বিচার করে, টেনে আনে সমাজকে। নারীপ্রশ্ন নারী নামে পরিচিত মানুষদের নিছক কিছু অধিকার বা আর্তনাদের বিষয় নয়।”
ফলে রোকেয়াকে কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ ‘নারী জাগরণের অগ্রদূত’ হিসেবে পরিচয় করে দেয়ার মধ্য দিয়ে রোকেয়ার কাজকে খর্বিত করা হয়েছে।
পাঠ্যবাইয়ে সংক্ষিপ্তরূপে রোকেয়ার জীবনী আলোচনা করেছে। কিন্তু এই আলোচনার কোথাও রোকেয়া যে সংগঠন করেছে সে তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। ১৯১৬ সালে রোকেয়া স্থাপন করেন ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম’। যা নারীমুক্তি প্রশ্নে নারীদের একত্রিত করার পদক্ষেপ। এছাড়া রোকেয়া ১৯২২ সালে ডা.লুৎফর রহমান প্রতিষ্ঠিত ‘নারীতীর্থ’ নামক সংগঠনের সভানেত্রী হিসেবে কাজ করেছেন। আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগে নারী যেখানে ঘরের কোণে বন্দী সেই সময় রোকেয়া সংগঠন প্রতিষ্ঠিত করেন এবং সমাজের চোখে হেয় ও হাস্যস্পদে পরিণত হয়েও সংগঠন এর কাজ সম্পন্ন করেছিলেন। অথচ হেয় ও হাস্যস্পদে পরিণত কয়েও সংগঠন এর কাজ সম্পন্ন করেছিলেন। অথচ আজ শিশুকে সংগঠক রোকেয়ার পরিচয় জানানো হয় না। কেন?
কারণ সংগঠিত মানুষই পারে সমাজের পশ্চাৎপদতা, কূপমন্ডূকতা, কুসংস্কারছন্নতা, ধমার্ন্ধতাকে পিছনে ফেলে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। সংগঠিত মানুষই পারে অন্যায়, অত্যাচার, অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াই করে মানবিক সমাজ গঠণ করতে। কিন্তু পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার কর্ণধাররা চায় মানুষের মাঝে বিচ্ছিন্নতা তৈরি করতে। শোষনমূলক এই ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই তারা চায় না মানুষ সংগঠিত হোক। তাই শিশুর মধ্যে সংগঠন চেতানা যেন তৈরি না হয় সেই চেষ্টা করে। ফলে রোকেয়াকে সংগঠক হিসেবে পরিচয় করে দেয় না।
পাঠ্য বইয়ে ভুল তথ্যে, বিকৃত তথ্যে, ব্যাখ্যাহীন তথ্যের মধ্য দিয়ে পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন উত্তরসূরি তৈরি ও খর্বিত ভাবে রোকেয়াকে উপস্থাপন সার্থক হয় যখন রংপুর সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের ৭ম শ্রেণির শিক্ষার্থী প্রশ্ন করে রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় হল কেন? রোকেয়া কি করেছেন? বেগম রোকেয়া মহিলা মহাবিদ্যালয় তো আছে তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম রোকেয়ার নামে হবে কেন? ৫ম শ্রেণীর ‘পরিবেশ পরিচিতি সমাজ’ বইয়ের রোকেয়া পাঠটি ঐ শিক্ষার্থীও পড়েছে। শিক্ষার্থীর রোকেয়া সম্পর্কে না জানার দায় তাহলে কার?
রোকেয়ার কাজ ও চেতনা সম্পর্কে শিশু যখন বিভ্রান্ত তখন তাঁর চিন্তা ধারণ ও বিকাশের পথও হয় বিভ্রান্ত। ফলে নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জিত হলেও সাংস্কৃতিক মুক্তি অর্জিত হচ্ছে না।
No comments