বুদ্ধিজীবী প্রসঙ্গে - কার্ল কাউটস্কি
ভূমিকাঃ
এখন পর্যন্ত বুদ্ধিজীবীতা অর্থাৎ বুদ্ধিজীবী সুলভ আচরণ বাংলাদেশসহ সারা দুনিয়ার বিপ্লবী আন্দোলনের একটি বড় সমস্যা। আমরা প্রায়ই বুদ্ধিজীবী সুলভ ও শ্রমিক সুলভ আচরণের কথা বলি। কেউ জেনে বলি, অনেকেই না জেনে বলি কিন্তু আমরা বলি। পার্টি কিংবা সংগঠনের যে কোনো কর্মসূচি নির্ধারণে, সংগঠনের ভাগ হওয়া, নিশ্চিহ্ন হওয়া অথবা গড়ে তোলায় বুদ্ধিজীবী/শ্রমিক শ্রেণীর দৃষ্টিভঙ্গির প্রধান ভূমিকা আছে।
লেনিনকে পার্টি গঠনকালে এই সমস্যায় পড়তে হয়েছিলো, তিনিও 'এক কদম আগে, দু'কদম পিছে' গ্রন্থে কার্ল কাউটস্কি-এর এই প্রবন্ধটি থেকে উদ্ধৃতি টেনেছেন। তিনি এই প্রবন্ধটি উদ্ধৃতি আকারে হাজির করতে গিয়ে লিখেছেন, ''সমপ্রতি কার্ল কাউটস্কি এই শেষোক্ত গুণটির যে একটি চমৎকার সামাজিক ও মনস্তাতি্বক বিশ্লেষণ করেছেন, এই প্রসঙ্গে তা স্মরণ না করে পারা যাচ্ছে না। বিভিন্ন দেশের সোশ্যাল-ডেমোক্রেটিক পার্টিগুলি ইদানিং একই পীড়ায় প্রায়শই ভুগছে এবং অভিজ্ঞদের কাছ থেকে সঠিক রোগ নির্ণয় ও সঠিক চিকিৎসা জেনে নিলে খুবই কাজের কাজ হবে।'' যাঁরা নিজেদের শ্রমিক শ্রেণীর সংগ্রামের একজন হিসেবে গড়ে তুলতে চান, তাঁদের অবশ্যই জানা থাকা দরকার বুদ্ধিজীবী ও শ্রমিকের আচরণ, আচরণের তফাৎ এবং তফাতের উৎস। এই বিষয়টি না জানলে শ্রমিক শ্রেণীর দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করা কঠিন, বিশেষত, শ্রমিক শ্রেণীর রাজনীতিতে অংশগ্রহণে আগ্রহী বুদ্ধিজীবীদের পক্ষে।
বহু সমস্যার অংশ হিসেবে বুদ্ধিজীবী এবং শ্রমিকশ্রেণীর বৈপরিত্যের সমস্যাটা বারবার সামনে চলে আসে।
এভাবে বিষয়টি অবতারণার জন্য আমার অনেক সহকর্মীই আমার উপর রাগ করতে পারেন। কিন্তু এই বৈষম্য তো জারি আছেই। যদি অন্যান্য অনেক বিষয়ের মত এই বিষয়টাকে পাশ কাটিয়ে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করা হয় তবে তা খুবই ভুল এবং অযৌক্তিক হবে।
এই বিরোধ সামাজিক যা শ্রেণীর সাথে যুক্ত ব্যক্তির সাথে নয়। একজন ব্যক্তি বুদ্ধিজীবী একজন ব্যক্তি পুঁজিপতির মত শ্রেণী সংগ্রামে যুক্ত হতে পারে। তার চরিত্রও এর সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়। যিনি ইতোমধ্যে ব্যতিক্রম হিসেবে পরিচিত এমন বুদ্ধিজীবীর জন্য এই আলোচনা নয়।
আমি বুদ্ধিজীবী বলতে সাধারণ বুদ্ধিজীবী শ্রেণীকেই বুঝি যারা বুর্জোয়া সমাজের পক্ষে কাজ করে এবং বুদ্ধিজীবীর সমস্ত বৈশিষ্ট্য ধারণ করে আর প্রলেতারিয়েত শ্রেণীর বিপক্ষে অবস্থান নেয়।
এই বিরোধের রূপ শ্রমিক ও পুঁজির বিরোধের চেয়ে ভিন্ন। বুদ্ধিজীবী পুঁজিপতি না যদিও তার জীবন যাপনের ধরণ বুর্জোয়া এবং খুব দরিদ্র না হলে সে এটা বজায় রাখতে চায়। কিন্তু একই সময়ে সে শ্রমের ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হয় এবং তার শ্রম বা ক্ষমতা সে প্রায়ই বিক্রি করে। পুঁজিপতির হাতে তাকে প্রায়ই শোষিত ও লাঞ্ছিত হতে হয়। এখানে অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে শ্রমিক ও বুদ্ধিজীবীর বিরোধ নেই। কিন্তু তার জীবন যাপনের পদ্ধতি এবং শ্রমের ধরণ শ্রমিক শ্রেণীর মতো না। এই অনুভুতিই এ ভাবাদর্শের বিরোধীতা তৈরি করে। বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি হিসেবে একজন প্রলেতারিয়েতের কোন পরিচয় নেই। তার শক্তি, অগ্রগতি, স্বপ্ন এবং আকাঙ্ক্ষা পুরোটাই সংগঠন থেকে আসে; একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অন্যান্য সহকর্মীদের সাথে বোঝাপড়ার মাধ্যমে তৈরী হয়। সে নিজেকে বড় কিংবা শক্তিশালী ভাবতে পারে যখন সে ঐ ধরণের কোন সংগঠনের অংশ। তার কাছে সংগঠই প্রধান বিষয়, ব্যক্তি খুবই কম গুরুত্বপূর্ণ।
ব্যক্তিগত সুবিধা বা গৌরব অর্জনের আকাঙ্ক্ষা ছাড়াই একজন প্রলেতারিয়েত প্রচন্ড নিবেদন নিয়ে যুদ্ধ করে জনমানুষের অংশ হিসেবে, একজন স্বেচ্ছাসেবকের শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে তার জন্য নির্দিষ্ট যে কোন অবস্থানেই সে কাজ করে অনুভুতি ও চিন্তার প্রকাশ হিসেবে।
বুদ্ধিজীবী ব্যাপারটা অনেকটাই ভিন্ন, সে যুদ্ধ করে যুক্তি দিয়ে শক্তি দিয়ে নয়। তার হাতিয়ার ব্যক্তিগত জ্ঞান, ক্ষমতা এবং বিচার বিবেচনা। কেবলমাত্র ব্যক্তিগত যোগ্যতা দিয়ে সমাজে সে অবস্থান তৈরি করতে পারে। সে কারণে ব্যক্তিগত যোগ্যতা জাহির করার মুক্ত সুযোগ তার কাছে সাফল্যের প্রধানতম শর্ত। একটা বৃহৎ এর তুলনা নগণ্য এবং যে কাজ করা হয় প্রয়োজন থেকে কোন ঝোঁক বা বিশেষ আগ্রহ থেকে নয়; এটাই তার কাছে মূর্তিমান সমস্যা বলে মনে হয়। সে শৃঙ্খলার প্রয়োজন মনে করে সাধারণের জন্য, নির্বাচিত সামান্যের জন্য নয় এবং স্বাভাবিক ভাবেই সে নিজেকে পরবর্তীদের কাতারেই ফেলে।
প্রলেতারিয়েত এবং বুদ্ধিজীবীর আবেগের মধ্যে যে বৈপরিত্য তার সাথে আরো একটা বিরোধ যুক্ত। বুদ্ধিজীবী যে সাধারণ শিক্ষা-দীক্ষায় সশস্ত্র; নিজেকে প্রলেতারিয়েতের চেয়ে উন্নত মনে করে। এমনকি এঙ্গেলস তার যুবক বয়সে শ্রমিক শ্রেণীকে উদ্দেশ্য করে যে সব লেখা লিখেছিলেন সেগুলো পান্ডিত্যপূর্ণ রহস্যে ঘেরা ছিল। বুদ্ধিজীবী দেখতে পায় যে, প্রলেতারিয়েতকে তার সমকক্ষ বন্ধু বা যোদ্ধা হিসেবে উপেক্ষা করা সহজ এবং প্রলেতারিয়েতদের মধ্যে যে নিম্নমানের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ লক্ষ্য করে আর ভেবে নেয় তাদের উন্নত করা তার দায়িত্ব। শ্রমিকদের মধ্যে নয় বরং সে সঙ্গী দেখে ছাত্রদের মধ্যে। লাসালের বিজ্ঞগণ ও প্রলেতারিয়েতের যুক্ততার প্রবাদের সাথে বুদ্ধিজীবীগণ আটকানো। যে যুক্ততা সমাজকে আরো উচ্চতায় নিয়ে যাবে। বিজ্ঞানের উকিল হিসেবে বুদ্ধিজীবীগণ শ্রমিকদের সাথে সঙ্গী হিসেবে একসাথে কাজ করার জন্য আসে না বরং সমাজের বাইরের শক্তি হিসেবে উদ্ধারকর্তা রূপে ত্রাণ নিয়ে আসে। লাসাল বিজ্ঞান ও প্রলেতারিয়েতের প্রবাদের চালু করেন। তার মতে, বিজ্ঞান রাষ্ট্রের মত শ্রেণী সংগ্রামের ঊধের্্ব। আমরা এখন জানি এটা মিথ্যা। রাষ্ট্র শাসক শ্রেণীর একটা যন্ত্র। বিজ্ঞান শ্রেণীর ঊধের্্ব এবং যতদূর মনে হয় এর সাথে শ্রেণীর কোন সম্পর্ক নেই যেন এটা প্রাকৃতিক ব্যাপার সামাজিক সম্পর্ক। অন্যভাবে উপসংহার পেঁৗছায় যেখানে সমাজকে দেখা হয় শ্রেণীর অবস্থান থেকে। বিশেষ করে এমন একটা শ্রেণীর অবদান থেকে যারা সেই সমাজের সাথে বিরোধের অবস্থানে আছে। বিজ্ঞানকে যখন পুঁজিবাদী শ্রেণীর কাছ থেকে প্রলেতারিয়েত শ্রেণীর কাছে আনা হয় তখন থেকেই বিজ্ঞান পুঁজিবাদী সমাজের স্বার্থে স্থির থেকেই খাপ খায়। প্রলেতারিয়েতদের নিজস্ব সামাজিক অবস্থান থেকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হওয়া দরকার। এই বিজ্ঞান একজন শ্রমিক, দাপ্তরিক এবং সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য পদ্ধতিতে শিখতে পারে না। প্রলেতারিয়েতও তার নিজের তত্ত্ব নিজেই বানাবে। এই কারণেই তাকে হতে হবে সম্পূর্ণ স্ব-শিক্ষিত। তার উৎস প্রতিষ্ঠানই হোক অথবা কোন প্রলেতারিয়েতই হোক সেটা কোন সমস্যা নয়। তার পাঠের উদ্দেশ্য হবে প্রলেতারিয়েতের কাজ, উৎপাদন প্রক্রিয়ায় এর ভূমিকা, শ্রেণীযুদ্ধে তার ভূমিকা। এইসব কাজ থেকেই তত্ত্ব, প্রলেতারিয়েতের আত্মসচেতনতা জাগানো সম্ভব।
বিজ্ঞানের শ্রমের সাথে যুক্ততা এবং মানবতাকে রক্ষা করা তার উদ্দেশ্য যেটা অ্যাকোডেমিশিয়ানদের বুর্জোয়া ক্লাসরুম যেভাবে শেখায় সেভাবে বুঝলে হবে না বরং বুঝতে হবে এই বোধ থেকে যে, প্রত্যেকেই আমাদের সহযোদ্ধা এবং অ্যাকোডেমিশিয়ান ও প্রলেতারিয়েতরা সমকক্ষ। যারা প্রলেতারিয়েতদের কাজ কর্মে অংশগ্রহণে সক্ষম তারা নতুন বৈজ্ঞানিক জ্ঞান তৈরি করবে একই সাথে। সে জ্ঞান প্রলেতারিয়েতদের সংগ্রামকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাবে।
বিজ্ঞান প্রলেতারিয়েতকে নিয়ন্ত্রণ করবে বা বিজ্ঞান ও প্রলেতারিয়েত দুটোই স্বাধীন শক্তি হিসেবে কাজ করবে এটা অসম্ভব।
প্রলেতরিয়েতকে মুক্ত করতে পারে এমন বিজ্ঞান তৈরি হতে পারে কেবল প্রলেতারিয়েতের হাতেই। উদারনৈতিকগণ বুর্জোয়া বিজ্ঞানের চৌহদ্দি থেকে যে কাজ করে সেগুলো মুক্ততার সংগ্রামকে জোরালো না করে প্রায়ই বর্তমান ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার পইে কাজ করে।
এইসব আলোচনা আমাদের মূল উদ্দেশ্য থেকে অপ্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে। কিন্তু যখন বুদ্ধিজীবী প্রশ্নটা এত প্রধান হয়ে সামনে আসছে তখন এসব অপ্রাসঙ্গিকতা মূল্যবোধহীন না।
নীৎশের দর্শন অতিমানবদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। যেখানে ব্যক্তির চরিতার্থতাই সব এবং ব্যক্তির কোন বড় সামজিক লক্ষ্যের জন্য অধনস্থনতা তার কাছে ঘৃণ্য, স্থূল। আর এটাই হল বুদ্ধিজীবীর আসল দর্শন। আর এই দর্শন শ্রেণী সংগ্রামে অংশগ্রহণে তাকে চূড়ান্তভাবে অযোগ্য বলে ঘোষণা করে।
নীৎশের পরে, ইবসেন হল ব্যক্তিবাদী দর্শনের বড় বক্তা। তার রচিত চরিত্র ড. স্টকম্যাম সাম্যবাদী নন, যেমনটা অনেকে ভাবেন বরং এমন ধরণের বুদ্ধিজীবী যে, প্রলেতারীয় আন্দোলনের সাথে বা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মতো অধিকাংশ লোকের মতামতকে গুরুত্ব দেয়া হয়। কোন একজন লোকের চেয়ে একজন বুদ্ধিজীবী লা স্টকম্যাম একটা নিবিড় সংখ্যাগরিষ্টকে দানব হিসেবে ভাবে যেটা অবশ্যই ছুড়ে ফেলা উচিত বলে সে মনে করে।
প্রলেতারিয়েত এবং বুদ্ধিজীবীর অনুভুতির পার্থক্যের কারণে যখনই একজন বুদ্ধিজীবী দলে যোগ দেয় তখনই খুব সহজে একটা দ্বন্দ্বের জন্ম হয়। দলে যোগ দেয়ায় যদি সে অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখোমুখি নাও হয় এবং আন্দোলন সম্পর্কে তার তাত্তি্বক জ্ঞান যথেষ্ঠই থাকে তবুও এই দ্বন্দ্ব হতে পারে। কেবল সাধারণ নয় অসাধারণ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী মানুষও প্রায়ই পার্টিতে ঢুকে মনে করতে পারে যে তার চূড়ান্ত সর্বনাশ হয়ে গেছে। সেই কারণে গণসংগঠনে যোগ দেয়ার আগে প্রত্যেক বুদ্ধিজীবীকে সচেতনভাবে, নীতিগতভাবে পরীক্ষা করে নেয়া উচিত। সংগঠন অবশ্যই পরীক্ষা করবে তাকে শ্রেণী সংগ্রামে যুক্ত করতে পারবে কিনা এবং কোন রকম পীড়িত, অধস্থন হচ্ছেন এমন মনোভাব ছাড়াই এই আন্দোলনে একজন সাধারণ সৈনিক হিসেবে সে নিজেকে ভাবতে পারছে কিনা। সে যোগ্য বলে বিবেচিত হবে কেবল তার পক্ষেই সম্ভব তার মেধা, শ্রম দিয়ে প্রলেতারিয় আন্দোলনে মূল্যবান সেবা দিতে এবং পার্টির কাজ করতে পেরে সে মহৎ সন্তোষ্টি অর্জন করবে। যে অযোগ্য তার জন্য অপেক্ষা করছে বড় রকমের দ্বন্দ্ব, বিরক্তি যা থেকে সে বা পার্টি কেউই লাভবান হবে না।
বুদ্ধিজীবীর আদর্শ উদাহরণ হিসেবে এমন একজনের উল্লেখ করা যায় যিনি প্রলেতারিয়েতের অনুভুতি ধরতে পেরেছিলেন। একজন প্রচন্ড মেধাবী লেখক হয়েও সম্পূর্ণভাবে বুদ্ধিজীবির নির্দিষ্ট আবরণ সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছিলেন। যিনি পার্টি থেকে অদৃষ্ট যে কোন কাজ করেছেন আনন্দের সাথে। যে কোন পদে কাজ করেছেন এবং পূর্ণ হৃদয় দিয়ে আন্দোলনের মহৎ লক্ষ্যে নিয়োজিত ছিলেন নীৎশে কিংবা ইবসেনের ব্যক্তিবাদীতার ধারনাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে। তিনি ভিলহেলম লিবক্লেখট। যার কাজ সোশালিস্ট আন্দোলনকে এগিয়ে দিয়েছিল। এরই সাথে আমরা আরো উল্লেখ করব মার্কসের কথা, যিনি নিজে কখনও সামনের সারিতে যাননি। আন্তর্জাতিকে তিনি আন্তরিক শৃঙ্খলার সাথে যোগ দিয়েছেন এবং যেখানে তাকে মুষ্ঠিমেয়ের সাথে দেখা যেত; এরাই আদর্শ।
লেনিনকে পার্টি গঠনকালে এই সমস্যায় পড়তে হয়েছিলো, তিনিও 'এক কদম আগে, দু'কদম পিছে' গ্রন্থে কার্ল কাউটস্কি-এর এই প্রবন্ধটি থেকে উদ্ধৃতি টেনেছেন। তিনি এই প্রবন্ধটি উদ্ধৃতি আকারে হাজির করতে গিয়ে লিখেছেন, ''সমপ্রতি কার্ল কাউটস্কি এই শেষোক্ত গুণটির যে একটি চমৎকার সামাজিক ও মনস্তাতি্বক বিশ্লেষণ করেছেন, এই প্রসঙ্গে তা স্মরণ না করে পারা যাচ্ছে না। বিভিন্ন দেশের সোশ্যাল-ডেমোক্রেটিক পার্টিগুলি ইদানিং একই পীড়ায় প্রায়শই ভুগছে এবং অভিজ্ঞদের কাছ থেকে সঠিক রোগ নির্ণয় ও সঠিক চিকিৎসা জেনে নিলে খুবই কাজের কাজ হবে।'' যাঁরা নিজেদের শ্রমিক শ্রেণীর সংগ্রামের একজন হিসেবে গড়ে তুলতে চান, তাঁদের অবশ্যই জানা থাকা দরকার বুদ্ধিজীবী ও শ্রমিকের আচরণ, আচরণের তফাৎ এবং তফাতের উৎস। এই বিষয়টি না জানলে শ্রমিক শ্রেণীর দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করা কঠিন, বিশেষত, শ্রমিক শ্রেণীর রাজনীতিতে অংশগ্রহণে আগ্রহী বুদ্ধিজীবীদের পক্ষে।
বহু সমস্যার অংশ হিসেবে বুদ্ধিজীবী এবং শ্রমিকশ্রেণীর বৈপরিত্যের সমস্যাটা বারবার সামনে চলে আসে।
এভাবে বিষয়টি অবতারণার জন্য আমার অনেক সহকর্মীই আমার উপর রাগ করতে পারেন। কিন্তু এই বৈষম্য তো জারি আছেই। যদি অন্যান্য অনেক বিষয়ের মত এই বিষয়টাকে পাশ কাটিয়ে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করা হয় তবে তা খুবই ভুল এবং অযৌক্তিক হবে।
এই বিরোধ সামাজিক যা শ্রেণীর সাথে যুক্ত ব্যক্তির সাথে নয়। একজন ব্যক্তি বুদ্ধিজীবী একজন ব্যক্তি পুঁজিপতির মত শ্রেণী সংগ্রামে যুক্ত হতে পারে। তার চরিত্রও এর সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়। যিনি ইতোমধ্যে ব্যতিক্রম হিসেবে পরিচিত এমন বুদ্ধিজীবীর জন্য এই আলোচনা নয়।
আমি বুদ্ধিজীবী বলতে সাধারণ বুদ্ধিজীবী শ্রেণীকেই বুঝি যারা বুর্জোয়া সমাজের পক্ষে কাজ করে এবং বুদ্ধিজীবীর সমস্ত বৈশিষ্ট্য ধারণ করে আর প্রলেতারিয়েত শ্রেণীর বিপক্ষে অবস্থান নেয়।
এই বিরোধের রূপ শ্রমিক ও পুঁজির বিরোধের চেয়ে ভিন্ন। বুদ্ধিজীবী পুঁজিপতি না যদিও তার জীবন যাপনের ধরণ বুর্জোয়া এবং খুব দরিদ্র না হলে সে এটা বজায় রাখতে চায়। কিন্তু একই সময়ে সে শ্রমের ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হয় এবং তার শ্রম বা ক্ষমতা সে প্রায়ই বিক্রি করে। পুঁজিপতির হাতে তাকে প্রায়ই শোষিত ও লাঞ্ছিত হতে হয়। এখানে অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে শ্রমিক ও বুদ্ধিজীবীর বিরোধ নেই। কিন্তু তার জীবন যাপনের পদ্ধতি এবং শ্রমের ধরণ শ্রমিক শ্রেণীর মতো না। এই অনুভুতিই এ ভাবাদর্শের বিরোধীতা তৈরি করে। বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি হিসেবে একজন প্রলেতারিয়েতের কোন পরিচয় নেই। তার শক্তি, অগ্রগতি, স্বপ্ন এবং আকাঙ্ক্ষা পুরোটাই সংগঠন থেকে আসে; একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অন্যান্য সহকর্মীদের সাথে বোঝাপড়ার মাধ্যমে তৈরী হয়। সে নিজেকে বড় কিংবা শক্তিশালী ভাবতে পারে যখন সে ঐ ধরণের কোন সংগঠনের অংশ। তার কাছে সংগঠই প্রধান বিষয়, ব্যক্তি খুবই কম গুরুত্বপূর্ণ।
ব্যক্তিগত সুবিধা বা গৌরব অর্জনের আকাঙ্ক্ষা ছাড়াই একজন প্রলেতারিয়েত প্রচন্ড নিবেদন নিয়ে যুদ্ধ করে জনমানুষের অংশ হিসেবে, একজন স্বেচ্ছাসেবকের শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে তার জন্য নির্দিষ্ট যে কোন অবস্থানেই সে কাজ করে অনুভুতি ও চিন্তার প্রকাশ হিসেবে।
বুদ্ধিজীবী ব্যাপারটা অনেকটাই ভিন্ন, সে যুদ্ধ করে যুক্তি দিয়ে শক্তি দিয়ে নয়। তার হাতিয়ার ব্যক্তিগত জ্ঞান, ক্ষমতা এবং বিচার বিবেচনা। কেবলমাত্র ব্যক্তিগত যোগ্যতা দিয়ে সমাজে সে অবস্থান তৈরি করতে পারে। সে কারণে ব্যক্তিগত যোগ্যতা জাহির করার মুক্ত সুযোগ তার কাছে সাফল্যের প্রধানতম শর্ত। একটা বৃহৎ এর তুলনা নগণ্য এবং যে কাজ করা হয় প্রয়োজন থেকে কোন ঝোঁক বা বিশেষ আগ্রহ থেকে নয়; এটাই তার কাছে মূর্তিমান সমস্যা বলে মনে হয়। সে শৃঙ্খলার প্রয়োজন মনে করে সাধারণের জন্য, নির্বাচিত সামান্যের জন্য নয় এবং স্বাভাবিক ভাবেই সে নিজেকে পরবর্তীদের কাতারেই ফেলে।
প্রলেতারিয়েত এবং বুদ্ধিজীবীর আবেগের মধ্যে যে বৈপরিত্য তার সাথে আরো একটা বিরোধ যুক্ত। বুদ্ধিজীবী যে সাধারণ শিক্ষা-দীক্ষায় সশস্ত্র; নিজেকে প্রলেতারিয়েতের চেয়ে উন্নত মনে করে। এমনকি এঙ্গেলস তার যুবক বয়সে শ্রমিক শ্রেণীকে উদ্দেশ্য করে যে সব লেখা লিখেছিলেন সেগুলো পান্ডিত্যপূর্ণ রহস্যে ঘেরা ছিল। বুদ্ধিজীবী দেখতে পায় যে, প্রলেতারিয়েতকে তার সমকক্ষ বন্ধু বা যোদ্ধা হিসেবে উপেক্ষা করা সহজ এবং প্রলেতারিয়েতদের মধ্যে যে নিম্নমানের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ লক্ষ্য করে আর ভেবে নেয় তাদের উন্নত করা তার দায়িত্ব। শ্রমিকদের মধ্যে নয় বরং সে সঙ্গী দেখে ছাত্রদের মধ্যে। লাসালের বিজ্ঞগণ ও প্রলেতারিয়েতের যুক্ততার প্রবাদের সাথে বুদ্ধিজীবীগণ আটকানো। যে যুক্ততা সমাজকে আরো উচ্চতায় নিয়ে যাবে। বিজ্ঞানের উকিল হিসেবে বুদ্ধিজীবীগণ শ্রমিকদের সাথে সঙ্গী হিসেবে একসাথে কাজ করার জন্য আসে না বরং সমাজের বাইরের শক্তি হিসেবে উদ্ধারকর্তা রূপে ত্রাণ নিয়ে আসে। লাসাল বিজ্ঞান ও প্রলেতারিয়েতের প্রবাদের চালু করেন। তার মতে, বিজ্ঞান রাষ্ট্রের মত শ্রেণী সংগ্রামের ঊধের্্ব। আমরা এখন জানি এটা মিথ্যা। রাষ্ট্র শাসক শ্রেণীর একটা যন্ত্র। বিজ্ঞান শ্রেণীর ঊধের্্ব এবং যতদূর মনে হয় এর সাথে শ্রেণীর কোন সম্পর্ক নেই যেন এটা প্রাকৃতিক ব্যাপার সামাজিক সম্পর্ক। অন্যভাবে উপসংহার পেঁৗছায় যেখানে সমাজকে দেখা হয় শ্রেণীর অবস্থান থেকে। বিশেষ করে এমন একটা শ্রেণীর অবদান থেকে যারা সেই সমাজের সাথে বিরোধের অবস্থানে আছে। বিজ্ঞানকে যখন পুঁজিবাদী শ্রেণীর কাছ থেকে প্রলেতারিয়েত শ্রেণীর কাছে আনা হয় তখন থেকেই বিজ্ঞান পুঁজিবাদী সমাজের স্বার্থে স্থির থেকেই খাপ খায়। প্রলেতারিয়েতদের নিজস্ব সামাজিক অবস্থান থেকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হওয়া দরকার। এই বিজ্ঞান একজন শ্রমিক, দাপ্তরিক এবং সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য পদ্ধতিতে শিখতে পারে না। প্রলেতারিয়েতও তার নিজের তত্ত্ব নিজেই বানাবে। এই কারণেই তাকে হতে হবে সম্পূর্ণ স্ব-শিক্ষিত। তার উৎস প্রতিষ্ঠানই হোক অথবা কোন প্রলেতারিয়েতই হোক সেটা কোন সমস্যা নয়। তার পাঠের উদ্দেশ্য হবে প্রলেতারিয়েতের কাজ, উৎপাদন প্রক্রিয়ায় এর ভূমিকা, শ্রেণীযুদ্ধে তার ভূমিকা। এইসব কাজ থেকেই তত্ত্ব, প্রলেতারিয়েতের আত্মসচেতনতা জাগানো সম্ভব।
বিজ্ঞানের শ্রমের সাথে যুক্ততা এবং মানবতাকে রক্ষা করা তার উদ্দেশ্য যেটা অ্যাকোডেমিশিয়ানদের বুর্জোয়া ক্লাসরুম যেভাবে শেখায় সেভাবে বুঝলে হবে না বরং বুঝতে হবে এই বোধ থেকে যে, প্রত্যেকেই আমাদের সহযোদ্ধা এবং অ্যাকোডেমিশিয়ান ও প্রলেতারিয়েতরা সমকক্ষ। যারা প্রলেতারিয়েতদের কাজ কর্মে অংশগ্রহণে সক্ষম তারা নতুন বৈজ্ঞানিক জ্ঞান তৈরি করবে একই সাথে। সে জ্ঞান প্রলেতারিয়েতদের সংগ্রামকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাবে।
বিজ্ঞান প্রলেতারিয়েতকে নিয়ন্ত্রণ করবে বা বিজ্ঞান ও প্রলেতারিয়েত দুটোই স্বাধীন শক্তি হিসেবে কাজ করবে এটা অসম্ভব।
প্রলেতরিয়েতকে মুক্ত করতে পারে এমন বিজ্ঞান তৈরি হতে পারে কেবল প্রলেতারিয়েতের হাতেই। উদারনৈতিকগণ বুর্জোয়া বিজ্ঞানের চৌহদ্দি থেকে যে কাজ করে সেগুলো মুক্ততার সংগ্রামকে জোরালো না করে প্রায়ই বর্তমান ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার পইে কাজ করে।
এইসব আলোচনা আমাদের মূল উদ্দেশ্য থেকে অপ্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে। কিন্তু যখন বুদ্ধিজীবী প্রশ্নটা এত প্রধান হয়ে সামনে আসছে তখন এসব অপ্রাসঙ্গিকতা মূল্যবোধহীন না।
নীৎশের দর্শন অতিমানবদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। যেখানে ব্যক্তির চরিতার্থতাই সব এবং ব্যক্তির কোন বড় সামজিক লক্ষ্যের জন্য অধনস্থনতা তার কাছে ঘৃণ্য, স্থূল। আর এটাই হল বুদ্ধিজীবীর আসল দর্শন। আর এই দর্শন শ্রেণী সংগ্রামে অংশগ্রহণে তাকে চূড়ান্তভাবে অযোগ্য বলে ঘোষণা করে।
নীৎশের পরে, ইবসেন হল ব্যক্তিবাদী দর্শনের বড় বক্তা। তার রচিত চরিত্র ড. স্টকম্যাম সাম্যবাদী নন, যেমনটা অনেকে ভাবেন বরং এমন ধরণের বুদ্ধিজীবী যে, প্রলেতারীয় আন্দোলনের সাথে বা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মতো অধিকাংশ লোকের মতামতকে গুরুত্ব দেয়া হয়। কোন একজন লোকের চেয়ে একজন বুদ্ধিজীবী লা স্টকম্যাম একটা নিবিড় সংখ্যাগরিষ্টকে দানব হিসেবে ভাবে যেটা অবশ্যই ছুড়ে ফেলা উচিত বলে সে মনে করে।
প্রলেতারিয়েত এবং বুদ্ধিজীবীর অনুভুতির পার্থক্যের কারণে যখনই একজন বুদ্ধিজীবী দলে যোগ দেয় তখনই খুব সহজে একটা দ্বন্দ্বের জন্ম হয়। দলে যোগ দেয়ায় যদি সে অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখোমুখি নাও হয় এবং আন্দোলন সম্পর্কে তার তাত্তি্বক জ্ঞান যথেষ্ঠই থাকে তবুও এই দ্বন্দ্ব হতে পারে। কেবল সাধারণ নয় অসাধারণ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী মানুষও প্রায়ই পার্টিতে ঢুকে মনে করতে পারে যে তার চূড়ান্ত সর্বনাশ হয়ে গেছে। সেই কারণে গণসংগঠনে যোগ দেয়ার আগে প্রত্যেক বুদ্ধিজীবীকে সচেতনভাবে, নীতিগতভাবে পরীক্ষা করে নেয়া উচিত। সংগঠন অবশ্যই পরীক্ষা করবে তাকে শ্রেণী সংগ্রামে যুক্ত করতে পারবে কিনা এবং কোন রকম পীড়িত, অধস্থন হচ্ছেন এমন মনোভাব ছাড়াই এই আন্দোলনে একজন সাধারণ সৈনিক হিসেবে সে নিজেকে ভাবতে পারছে কিনা। সে যোগ্য বলে বিবেচিত হবে কেবল তার পক্ষেই সম্ভব তার মেধা, শ্রম দিয়ে প্রলেতারিয় আন্দোলনে মূল্যবান সেবা দিতে এবং পার্টির কাজ করতে পেরে সে মহৎ সন্তোষ্টি অর্জন করবে। যে অযোগ্য তার জন্য অপেক্ষা করছে বড় রকমের দ্বন্দ্ব, বিরক্তি যা থেকে সে বা পার্টি কেউই লাভবান হবে না।
বুদ্ধিজীবীর আদর্শ উদাহরণ হিসেবে এমন একজনের উল্লেখ করা যায় যিনি প্রলেতারিয়েতের অনুভুতি ধরতে পেরেছিলেন। একজন প্রচন্ড মেধাবী লেখক হয়েও সম্পূর্ণভাবে বুদ্ধিজীবির নির্দিষ্ট আবরণ সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছিলেন। যিনি পার্টি থেকে অদৃষ্ট যে কোন কাজ করেছেন আনন্দের সাথে। যে কোন পদে কাজ করেছেন এবং পূর্ণ হৃদয় দিয়ে আন্দোলনের মহৎ লক্ষ্যে নিয়োজিত ছিলেন নীৎশে কিংবা ইবসেনের ব্যক্তিবাদীতার ধারনাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে। তিনি ভিলহেলম লিবক্লেখট। যার কাজ সোশালিস্ট আন্দোলনকে এগিয়ে দিয়েছিল। এরই সাথে আমরা আরো উল্লেখ করব মার্কসের কথা, যিনি নিজে কখনও সামনের সারিতে যাননি। আন্তর্জাতিকে তিনি আন্তরিক শৃঙ্খলার সাথে যোগ দিয়েছেন এবং যেখানে তাকে মুষ্ঠিমেয়ের সাথে দেখা যেত; এরাই আদর্শ।
অনুবাদ : মেহেদী হাসান
No comments