আমাদের রোকেয়া পাঠ-২ // অনামিকা দেবগুপ্ত
(রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক চেতনাসম্পন্ন নারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মধ্যে দিয়ে গড়ে উঠবে মানবিক সমাজ। মানবিক সমাজ নির্মাণে যখন নারী-পুরুষের সম্মিলিত কাজ প্রয়োজন তখন দাসত্বসূচক অলংকার পরিহিত, সৌন্দর্যচর্চাকারী দাসী হওয়ার জন্য তৈরি হয় নারী। আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন মানুষ হওয়ার পরিবর্তে আত্মসম্মানহীন দাসী হওয়াতেই গর্ববোধ করে। প্রচন্ড ঠান্ডায় শরীরের যখন উত্তাপ প্রয়োজন তখন মাথায় মেহেদী -মেথি মেখে ঘন্টা খানেক পর শ্যাম্পু করা এবং প্রচন্ড গরমে কারুকার্যময় ভারী কাপড়-চোপড় পড়ে, মেকআপ করে সৌন্দর্যচর্চা করা শরীর সুস্থ থাকার থেকে বেশি প্রয়োজনীয়! মেধা-মনন-সৃজনশীল কাজের মধ্যে দিয়ে সমাজের জন্য তৈরি না হয়ে ‘বর’ নামক পুরুষের জন্য তৈরি হয় নারী। স্বাধীনতার কথা বলে ‘নারী’ তবে সে স্বাধীনতা ‘পণ্য’ কেনার স্বাধীনতা, সে স্বাধীনতা ‘নারী’ হিসেবে সুযোগ নেওয়ার স্বাধীনতা। রোকেয়া অবরোধবাসী নারীর মানসিক দাসত্ব, দাসত্বসূচক অলংকারের ব্যবহার, সৌন্দর্যচর্চা, আত্মসম্মানবোধহীনতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, বিশ্লেষণ করেছেন এবং উত্তরণের জন্য কাজ করেছেন। নারী যেন রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক চেতনাসম্পন্ন মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় সে লক্ষ্যে যেমন কলম ধরেছেন, তেমনি ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’ এর শিক্ষাদান পদ্ধতি ও ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম’ সংগঠন এর কর্মকান্ড এবং বিভিন্ন সাংগঠনিক কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করেছেন। মানবিক সমাজ গঠনের নারী-পুরুষের সম্মিলিত কাজের স্বপ্ন দেখলেও তৎকালীন সমাজের প্রেক্ষাপটে তাঁকে শুধু নারীকে নিয়ে কাজ করতে হয়েছে। অথচ বর্তমানে নারী ঘরের বাহিরে এসেছে। প্রশাসনিক কর্মকান্ড, কৃষিকাজ, শিল্প-কারখানায়, ব্যবসায় অর্থাৎ সর্বস্তরে কাজ করছে। নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জিত হলেও রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক চেতনাসম্পন্ন মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি নারী। কিন্তু কেন?
কারণটি অনুসন্ধানের জন্য যেমন প্রয়োজন সমাজের আর্থ-সামাজিক বিশ্লেষণ তেমনি প্রয়োজন শিক্ষা পদ্ধতির বিশ্লেষণ। কারণ শাসকশ্রেণি তার শাসনকে টিকিয়ে রাখার জন্য শাসন ব্যবস্থার উপযোগী শিক্ষা পদ্ধতি প্রণয়ন করে থাকে।
রোকেয়া নারীকে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক চেতনাসম্পন্ন মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য শিক্ষাকে উত্তরণের পথ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। অথচ মেধা-মনন বুদ্ধিমত্তা যোগ্যতা দিয়ে ‘মানুষ’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত না হয়ে ‘নারী’ আত্মসম্মানবোধহীন পুরুষের মনোরঞ্জনের জন্য ‘ভোগপণ্যে’ পরিণত হচ্ছে। অন্যদিকে পুরুষ ও নারীকে আত্মসম্মানবোধহীন, পুরুষের থেকে কমবুদ্ধিসম্পন্ন, কমযোগ্যতা সম্পন্ন পুরুষের ‘ভোগপণ্য’ দাসীরূপে ভাবে। ‘নারী’ মানুষ সেও যে পুরুষের সমকক্ষ সেভাবে কখনই মূল্যায়ন করে না ‘পুরুষ’। তাহলে এই শিক্ষা কাঠামোয় কোন শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে শিক্ষার্থী?
তাই ‘মুক্তচিন্তা গবেষণা সেল’ শিক্ষা কাঠামোতে রোকেয়াকে কিভাবে জানছি, রোকেয়ার লেখা কিভাবে পাঠ করছি এ নিয়ে ধারাবাহিক লেখা প্রকাশ করছে। এর ১ম অংশ প্রাথমিক স্তরের পর্যালোচনা গত সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। এ সংখ্যায় প্রকাশ হচ্ছে মাধ্যমিক স্তরের পাঠ পর্যালোচনা। )
এখন দেখা যাক ৭ম শ্রেণির পাঠে রোকেয়াকে কিভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে ঃ সপ্তম শ্রেণির “সপ্তবর্ণা” বইয়ে সেলিনা হোসেন রচিত রোকেয়ার জীবনী দেয়া হয়েছে। সহজ, সরল ও প্রাণোজ্জ্বল ভাষায় শিশুদের উপযোগী করে অল্প পরিসরে রোকেয়ার সময়ের সমাজ ব্যবস্থা, শিক্ষালাভ, সাহিত্যচর্চা, স্কুল ও সংগঠন প্রতিষ্ঠা ও কার্যক্রম পরিচালনার বর্ণনা, তাঁর কাজের মূল্যায়ন তুলে ধরেছেন। ধন্যবাদ সেলিনা হোসেনকে। কিন্তু তিনি লেখাটি সংক্ষিপ্ত করায় অনেক তথ্যের ব্যাখ্যা দেননি। যা শিশুর মানসিক বিকাশের অন্তরায়। আবার লেখাটিতে কিছু অনিচ্ছাকৃত ভুল তথ্যে দেয়া হয়েছে যা শিশুকে করবে বিভ্রান্ত। কিছু বাক্যে রোকেয়াকে ‘মানুষ’ হিসেবে বিবেচনা না করে ‘নারী’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। যা রোকেয়ার চিন্তার বিরোধী। তথ্যেগুলো নিয়ে আলোচনা করা যাক ঃ
পাঠের ২য় অনুচ্ছেদে আছে “এই পরিবারে পাঁচটি সন্তান জন্মগ্রহন করেন। দুই পুত্রের নাম আবুল আসাদ ইব্রাহীম সাবের ও খলিল সাবের। তিন কন্যার নাম করিমুন্নেসা, রোকেয়া ও হোসাফরা।
বাংলা একাডেমী কর্তৃক প্রকাশিত ‘রোকেয়া রচনা সমগ্র’ এর তথ্য অনুযায়ী, “রোকেয়ার তৃতীয় ভাই ইসরাইল আবু হাফস সাবের (ছোট বেলায় মৃত) এবং তৃতীয় বোনের নাম হোমায়রা।” (পৃষ্ঠা ৫৪৩) ছোট বেলায় মৃত হওয়ায় সেলিনা হোসেন হয়ত তৃতীয় ভাইয়ের কথা উল্লেখ করেন নি এবং প্রিন্ট করতে হোমায়রা, হোসাফরা হয়েছে। কিন্তু কোন শিশু যদি বাংলা একাডেমীর তথ্য থেকে উত্তর করে তাহলে শিশুর উত্তর ভুল হিসেবে গণ্য করা হবে। (বেশির ভাগ শিক্ষকরা যেহেতু সংশ্লিষ্ট বিষয়ের উপর আনুষঙ্গিক বইপত্র পড়েন না ফলে, পাঠে যেভাবে তথ্য উপস্থাপন করা হয় সেভাবে উত্তর মূল্যায়ন করেন)। তাহলে শিশুরা ভুল না করেও ভুলের দায় বহন করবে কেন? এরপর লেখাটিতে আছে “নানা বাধা এড়িয়ে রোকেয়া আপন সাধনায় বাংলা ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন। তাই রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন আমাদের সামনে একজন অসাধারণ নারী।”
‘রোকেয়া’ নারী ও ‘রবীন্দ্রনাথ’ পুরুষ। তাঁদের এই পরিচয়ের থেকে বড় পরিচয় তাঁরা মানুষ।
নবম-দশম শ্রেণির মাধ্যমিক বাংলা সংকলন বইয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘..............তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থেই অসামান্য প্রতিভাধর ব্যক্তি।” অর্থাৎ ‘রবীন্দ্রনাথ’ ব্যক্তি তথা মানুষ কিন্তু ‘রোকেয়া’ নারী।
রোকেয়া নারীদের আহবান জানিয়েছেন, “ভগিনীগণ! চক্ষু রগড়াইয়া জাগিয়া উঠুন-অগ্রসর হউন! বুক ঠুকিয়া বল মা ! আমরা পশু নই ; বল ভগিনী! আমরা আসবাব নই; বল কন্যে! আমরা জড়াউ অলঙ্কাররূপে লোহার সিন্দুকে আবদ্ধ থাকিবার বস্তু নই ; সকলে সমস্বরে বল, আমরা মানুষ !” (সুবেহ সাদেক, বা.এ.)
অথচ রোকেয়ার পরিচয় দেয়া হয় শুধু নারী, মানুষ হিসেবে নয়।
এই পাঠেই সেলিনা হোসেন লিখেছেন, “রোকেয়া এই উপমহাদেশের একজন দূরদৃষ্টি সম্পন্ন মানুষ।” অর্থাৎ সেলিনা হোসেন ‘রোকেয়া’কে নারী নয় ‘মানুষ’ মনে করেন। কিন্তু প্রশ্ন হল রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গে কখনোও কি কেউ লিখেছেন যে, ‘রবীন্দ্রনাথ’ ছিলেন অসাধারণ পুরুষ ! অথবা কোন পুরুষ ব্যক্তিত্বদের কি এই বিশেষণে ভূষিত করা হয়েছে ? না করা হয়নি। কারণ পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় পুরুষ মানুষ হিসেবে গণ্য হলেও নারীকে প্রতিষ্ঠিত করা হয় ‘নারী’ হিসেবেই। যেন ‘নারী’ শব্দটি নির্দেশ করে অধস্তনতা। নারী ও পুরুষের মাঝে জৈবিক সম্পর্ক, সন্তান ধারণ ছাড়া অন্যসব কাজে পার্থক্য না থাকলেও সমাজের সর্বস্তরে নারী-পুরুষের মূল্যায়ন করা হয় বৈষম্যমূলকভাবে। তাই পাঠ্যপুস্তকে বৈষম্যমূলক শব্দ, বাক্যের মধ্যে দিয়ে শিক্ষার্থীদের বৈষম্যমূলক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করা হয়। সেলিনা হোসেন রোকয়াকে নারী নয় মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করলেও নারী শব্দটি গ্রহণ করেছেন। যা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা, সাহিত্য, প্রচার মাধ্যমের ফল নয় কি ?
এরপর আছে , “স্বামীর সহযোগিতায় তিনি তাঁর পড়াশোনার চর্চা চালিয়ে যেতে পারেন।”
রোকেয়া স্বামী শব্দটির বিরোধীতা করলেও এখানে স্বামী শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। রোকেয়ার স্বামী শব্দটির সাথে ‘প্রভূত্ব’ সম্পর্কিত তার অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ করেছেন ‘স্ত্রী জাতির অবনতি’ প্রবন্ধে।
তিনি লিখেছেন, “তাই দেখা যায়, আমাদের যখন স্বাধীনতা ও অধীনতাজ্ঞান বা উন্নতি ও অবনতির যে প্রভেদ তাহা বুঝিবার সামর্থ্যটুকুও থাকিল না। তখন কাজেই তাঁহারা ভূস্বামী, গৃহস্বামী প্রভৃতি হইতে হইতে ক্রমে আমাদের ‘স্বামী’ হইয়া উঠিলেন!” (বা-এ পৃ ১২)
আবার সমাজে দাম্পত্য সম্পর্কটি যে মূলত ‘দাসী-প্রভূর’ সম্পর্ক সে বিষয়ে উক্ত প্রবন্ধে ফুটনোটে লিখেছেন, “ ‘দাসী’ শব্দে অনেক শ্রীমতি আপত্তি করিতে পারেন। কিন্তু জিজ্ঞাসা করি “স্বামী” শব্দের অর্থ কি ? দানকর্ত্তাকে “দাতা” বলিলে যেমন গ্রহণ কর্ত্তাকে “গ্রহীতা” বলিতেই হয়, সেইরূপ একজনকে “স্বামী, প্রভূ, ঈশ্বর” বলিলে অপরকে “দাসী” না বলিয়া আর কি বলিতে পারেন ? যদি বলেন স্ত্রী পতি-প্রেম- পাশে আবদ্ধ হওয়ায় তার সেবিকা হইয়াছেন, তবে ওরূপ সেবাব্রত গ্রহণে অবশ্য কাহারও আপত্তি হইতে পারে না। কিন্তু পুরুষও কি ঐরূপ পারিবারিক প্রেমে আবদ্ধ হইয়া তাহাদের প্রতিপালনরূপ সেবাব্রত গ্রহণ করেন নাই? দরিদ্রতম মজুরটিও সমস্ত দিন অনশনে পরিশ্রম করিয়া সন্ধ্যায় দুই এক আনা পয়সা পারিশ্রমিক পাইলে বাজারে গিয়া প্রথমে নিজের উদর-সেবার জন্য দুই পয়সার মুড়িমুড়কীর শ্রাদ্ধ করে না। বরং তদ্বারা চাউল ডাউল কিনিয়া পতœীকে আনিয়া দেয়। পতœীটি রন্ধনের পর “স্বামী” কে যে “একমুঠা-আধপেটা” অন্নদান করে, পতি বেচারা তাহাতেই সন্তষ্ট হয়। কি চমৎকার আত্মত্যাগ। সমাজ তবু বিবাহিত পুরুষকে “প্রেম-দাস” না বলিয়া স্বামী বলে কেন?” (বা.এ.পৃ.-১৩) অন্যদিকে রোকেয়া দাম্পত্য সম্পর্কটিকে প্রভূ-দাসীর সম্পর্করূপে নয় বন্ধুত্বপূর্ণ, সহযোগিতাপূর্ণ, সহমর্মিতাপূর্ণ পারস্পারিক সম্পর্করূপে রূপায়ন করেছেন।
অর্দ্ধাঙ্গী যখন অর্দ্ধাঙ্গের সমস্যা বুঝেনা এবং সহযোগিতা করে না তিনি এরকম সম্পর্ককেও কটাক্ষ করেছেন। “খ্রীষ্টিয়ান সমাজে যদিও স্ত্রী শিক্ষার যথেষ্ট সুবিধা আছে, তবু রমনী আপন স্বত্ব ষোল আনা ভোগ করিতে পায় না। তাহাদের মন দাসত্ব হইতে মুক্তি পায় না। স্বামী ও স্ত্রী কতক পরিমানে জীবনের পথে পাশাপাশি চলিয়া থাকেন বটে; কিন্তু প্রত্যেক উত্তমার্দ্ধই তাঁহার অংশীর (ইবঃঃবৎ যধষভ) জীবনে আপন জীবন মিলাইয়া তন্ময়ী হইয়া যান না। স্বামী যখন ঋণ জালে জড়িত হইয়া ভাবিয়া ভাবিয়া মরনে মরিতেছেন, স্ত্রী তখন একটা নূতন টুপীর চিন্তা করিতেছেন ! কারণ তাঁহাকে কেবল মূর্ত্তিমতী কবিতা হইতে শিক্ষা দেওয়া হইয়াছে- তাই তিনি মনোরমা কবিতা সাজিয়া থাকিতে চাহেন। ঋণদায়রূপ গদ্য অবস্থা তিনি বুঝিতে অক্ষম।” (অর্দ্ধাঙ্গী বা.এ.পৃ.-২৯)
আর ‘অর্দ্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধের শেষে আশা ব্যক্ত করেছেন, “আশা করি এখন “স্বামী” স্থলে “অর্দ্ধাঙ্গ” শব্দ প্রচলিত হইবে। অথচ বর্তমানেও “স্বামী” শব্দটির পরিবর্তে ‘অর্দ্ধাঙ্গ’ শব্দটির ব্যবহার শুরু হয় নি। কারণ পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা চায় পুরুষের আধিপত্য। পুরুষের প্রভূত্ব। তাই পাঠ্যপুস্তক শুধু নয় প্রশাসনিক নথিপত্র, প্রচার-মাধ্যম সর্বত্রই ‘স্বামী’ শব্দটির বহুল প্রচার নিশ্চিত করেছেন পুরুষতন্ত্রের শাসক শ্রেণি। কোমলমতি শিশুদেরও পাঠ্যপুস্তকের মধ্য দিয়ে প্রভূত্বসূচক ‘স্বামী’ শব্দটির ব্যবহার করতে দীক্ষিত করা হচ্ছে। মজা দেখুন রোকেয়া স্বামী শব্দটির বিরোধিতা করলেও সাখাওয়াত হোসেনকে ‘প্রভূ’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে এবং দাসী হিসেবে ‘রোকেয়া’ যেন সাখাওয়াত হোসেনের ইচ্ছা পূরণ করেছেন। অনেকেই প্রশ্ন তুলতে পারেন যে, ‘রোকেয়া নিজেও বিভিন্ন প্রবন্ধে এই শব্দটির ব্যবহার করেছেন।’ তাদের কাছে প্রশ্ন ‘ রোকেয়ার সময় ও বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপট কি একই ?’
‘রোকেয়া’র পরে কোন কবি, লেখক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবি এবং সমাজরূপান্তরে লক্ষ্যে কাজ করেন যে প্রগতিশীলরা তাঁরাও এ শব্দটির কখনও বিরোধিতা করেন নি বরং শব্দটির ব্যবহার নিশ্চিত করেছেন।
কিন্তু রোকেয়া ও সাখাওয়াতের সম্পর্ক ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ, সহযোগিতাপূর্ণ, সহমর্মিতাপূর্ণ। তাহলে তাঁদের দাম্পত্য সম্পর্ককে ‘প্রভু-দাসী’র সম্পর্করূপে উপস্থাপন করা উদ্দেশ্য কি?
এরপর তিনি লিখেছেন, “১৯১৫ সালে তিনি ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম’ নামে একটি মহিলা সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন।”
বাক্যটি হবে, “১৯১৬ সালে তিনি ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম’ নামে একটি মহিলা সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। (তথ্য বা এ পৃ-৫৪৭) এই ভুলের জন্য শিশুরা দুই ধরণের ক্ষতিগ্রস্থ হবে। এক. তারা ভুল তথ্যে জানবে এবং দুই. সঠিক তথ্যে জানলেও তাদের জানা ভুল হিসেবে মূল্যায়ন করা হবে।
‘আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম’ মহিলা সংগঠন এর লক্ষ্য বর্ণনা করা হয়েছে এভাবে, “এই প্রতিষ্ঠান থেকে দুঃস্থ নারীদের বিভিন্নভাবে সাহায্য করা হতো। তাদের হাতের কাজ শেখানো হতো, সামান্য লেখাপড়া শেখানোর ব্যবস্থাও ছিল। এক কথায় এই সংগঠনটির লক্ষ্য ছিল সমাজের সাধারণ দুঃস্থ নারীদের স্বাবলম্বী করে তোলা।”
কিন্তু ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম’ এর উদ্দেশ্য, “ মুসলমান নারী সমাজের সর্বাঙ্গীন উন্নতি সাধনই এই সমিতির মূল উদ্দেশ্য। দীর্ঘকালের সামাজিক কুসংস্কার পরিত্যাগ করিয়া শিক্ষাক্ষেত্রে, সমাজে পারিবারিক জীবনে, সকল দিক দিয়া তাঁহারা আত্মপ্রতিষ্ঠা হইবেন-সুগৃহিনী, সুজননী ও সুনাগরিক হইয়া সর্বত্র নিজের বিশিষ্ট স্থানটুকু অধিকার করিবেন ইহাই আঞ্জুমানে খাওয়াতীনের একমাত্র লক্ষ্য।” (বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন চিন্তা-চেতনার ধারা ও সমাজ কর্ম, তাহ্মিনা আলমা /পৃষ্ঠা ১৬৩) প্রশ্ন জাগে, ‘সাধারণ দুঃস্থ নারীদের স্বাবলম্বী’ ও ‘মুসলমান নারী সমাজের সর্বাঙ্গীন উন্নতি সাধন’ কি একই ?
সেলিনা হোসেন পাঠে রোকেয়ার কাজের পদ্ধতি ও সমাজ কর্তৃক তাঁর কাজের স্বীকৃতি নিয়ে লিখেছেন, “রোকেয়া এই উপমহাদেশের একজন দূরদৃষ্টি সম্পন্ন মানুষ। নারী শিক্ষার অগ্রদূত হিসেবে বাঙালি মুসলিম সমাজের কাছে শ্রদ্ধেয়। বিংশ শতাব্দীর সূচনায় তিনি দুই ভাবে নারীদের মুক্তির পথ দেখেছিলেন। এক. মেয়েদের জন্য স্কুল স্থাপন করে। দুই. নিজের রচনায় মুক্তির দিক নির্দেশনা দিয়ে। নারীবাদী লেখকরা রোকেয়াকে উপমহাদেশের প্রথম নারীবাদী হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তবে সর্বকালে সর্বশ্রেষ্ঠ এই বাঙালি নারী যে নারীমুক্তির অগ্রদূত ছিলেন তাতে কোনো দ্বিধার কারণ নেই।”
কাজে স্বীকৃতি হিসেবে রোকেয়াকে, ‘নারী জাগরণের অগ্রদূত’, নারী শিক্ষার অগ্রদূত, ‘মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূত’, ‘নারী মুক্তির অগ্রদূত’ বলা হয়ে থাকে।
এখন পাঠের উদ্দেশ্য, কর্ম -অনুশীলন ও প্রশ্নাবলী নিয়ে আলোচনা করা যাক।
মজার ব্যপার হল, এই পাঠের উদ্দেশ্য হল নারীর কর্মজগতের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত করা। অর্থাৎ রোকেয়া পাঠের মধ্যে দিয়ে রোকেয়ার চিন্তা- চেতনা ও কাজের সাথে শিশুদের পরিচয় করা ও রোকেয়ার চিন্তার বিকাশের লক্ষ্যে এ পাঠ নয়। রোকেয়ার কাজকে মানুষের কাজ হিসেবে মূল্যায়ন না করে নারীর কাজ হিসেবে মূল্যায়ন করার শিক্ষা দেয়াই এই পাঠের উদ্দেশ্য।
আবার পাঠ পরিচিতি পড়লে মনে হয়, সেলিনা হোসেন পাঠে রোকেয়ার লেখালেখি বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়েছেন। অথচ তিনি পাঠে রোকেয়ার সময়ের সামাজিক অবস্থা, পরিবার, শিক্ষা লাভ, বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা, সংগঠন প্রসঙ্গ, সাহিত্যচর্চা, তাঁর কাজের মূল্যায়ন করেছেন। এখানে পাঠ উদ্দেশ্য ও পাঠ পরিচিতিতে রোকেয়ার লেখালেখিকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ সেলিনা হোসেনের সামগ্রিক রোকেয়াকেও খন্ডিত করা হয়েছে।
কর্ম অনুশীলন নির্ধারণ করা হয়েছে, “ শিক্ষার্থীরা পরিচিত মহিয়সী নারীর (মা, বোন, শিক্ষিকা প্রমূখ) কর্মজগৎ নিয়ে রচনা লিখবে।” অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের নারী ও পুরুষকে আলাদা করে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি তৈরী করাই এই কর্ম অনুশীলন এর উদ্দেশ্য। আবার পদের অর্থাৎ কাজের কোন লিঙ্গ হয় না জন্য ‘নেত্রী, জনাবা, শিক্ষিকা’ প্রভৃতি শব্দগুলোকে বাতিল করা হয়েছে। অথচ শব্দগুলো এখনো ব্যবহৃত হয়। হয়ত, যারা ব্যবহার করেন তারা এ সম্পর্কে জানেন না। আবার জানলেও বোঝেন না অর্থাৎ মূর্খ। কিন্তু বোর্ড কর্তৃক প্রকাশিত বইয়ে, ‘শিক্ষিকা’ শব্দটির ব্যবহার কতটা যৌক্তিক।
আবার মজার ব্যাপার হল, সেলিনা হোসেন তাঁর রচনায় কোথাও ‘বেগম রোকেয়া’ ব্যবহার করেননি। অথচ প্রশ্নকর্তারা বেগম রোকেয়া পরিচয় দিতে বদ্ধপরিকর। তাই বহু নির্বাচনি প্রশ্ন ও সৃজনশীল প্রশ্নে রোকেয়াকে ‘বেগম রোকেয়া’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
বহুনির্বাচনি প্রশ্নের গদ্যাংশে লেখা আছে, “পড়াশোনার প্রতি আমেনার প্রচন্ড আগ্রহ। স্কুল বাড়ি থেকে অনেক দূরে। কোনো সহপাঠীও কাছাকাছি থাকেনা। কেবল মায়ের প্রেরণা ও নিজের প্রবল ইচ্ছাশক্তি আমেনাকে অসাধ্য সাধনে প্রেরণা জুগিয়েছে।”
অনুচ্ছেদের আমেনার প্রচেষ্টা প্রবন্ধের কোন চরিত্রের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায়? ক) ইব্রাহীম, খ) খলিলের, গ) বেগম রোকেয়ার, ঘ) হোসাফরার।
প্রশ্ন হচ্ছে যে, রোকেয়ার সময়ের সামজিক অবস্থা ও বর্তমান সময়ের সামাজিক অবস্থা কি একই? যদি না হয় তাহলে তাঁদের প্রচেষ্টার মিল করা কি মূর্খতা নয়?
সৃজনশীল প্রশ্নে ১. অনুচ্ছেদে দেয়া আছে, “ শরীফা চৌধুরী হার না মানা মনোভাব ও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে আজ সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত। কিন্তু শৈশবে তিনি পড়াশোনার তেমন সুযোগ পান নি। জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে তিনি বুঝতে পেরেছেন, সমাজে মেয়েরা পিছিয়ে আছে। তাই তিনি খুঁজে খুঁজে অসহায় মেয়েদের স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। শত বাধা আসলেও মেয়েদের শিক্ষার বিষয়ে আপস করেন নি তিনি।”
প্রশ্ন (ঘ) হল “শরীফা চৌধুরী বেগম রোকেয়ার অসমাপ্ত কাজকেই পূর্ণতা দেয়ার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন - বিশ্লেষণ কর।”
এ প্রশ্নের উত্তরের জন্য প্রথমে জানা প্রয়োজন রোকেয়ার চিন্তা-চেতনা সম্পর্কে। আর তিনি তাঁর চিন্তার লক্ষ্যে কতটুকু কাজ করতে পেরেছেন এবং অসমাপ্ত কাজ কি ? তা জানার জন্য রোকেয়া রচনা সমগ্র, রোকেয়ার চিঠি-পত্র, রোকেয়া নিয়ে পড়া প্রয়োজন। উক্ত বিষয়গুলো শিক্ষার্থীরা অল্প পরিসরের এই পাঠে রোকেয়া সম্পর্কে জানলেও রোকেয়ার চিন্তার সাথে পরিচিত হবে না। আনুষঙ্গিক পড়াশুনা না করার ফলে শিক্ষকও রোকেয়ার চিন্তার সাথে শিক্ষার্থীদের পরিচিত করে দিতে পারবে না।
অন্যদিকে শরীফা চৌধুরীর চিন্তা-চেতনা সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। কিন্তু অনুচ্ছেদটি পড়ে শরীফা চৌধুরীর চিন্তার পরিচয় পাওয়া যায় না। তাহলে কিভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া যায় শরীফা চৌধুরী রোকেয়ার অসমাপ্ত কাজকেই পূর্ণতা দেয়ার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন?
এভাবেই পাঠের উদ্দেশ্য, পাঠ পরিচিতি, কর্মঅনুশীলন, প্রশ্নাবলীতে রোকেয়ার কাজকে খন্ডিতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। বারবার রোকেয়ার মানুষ পরিচয়কে গৌণ করে , নারী পরিচয়কে মুখ্য করে তাঁর চিন্তা-চেতনা ও কাজকে খন্ডিত করা হচ্ছে কেন? বাংলার আরেকটি পাঠ ‘রচনা সম্ভার’। ৭ম-৮ম শ্রেণির ‘রচনা সম্ভার’ বইয়ে রোকেয়াকে নিয়ে লেখা রচনা দেয়া হয়েছে। ইতিহাসের অনিবার্যতাকে অস্বীকার করে ভুল তথ্যে ও মনগড়া বাক্যের মধ্য দিয়ে রোকেয়াকে উপস্থাপন করা হয়েছে এই পাঠে।
‘রচনা সম্ভার’ বইয়ে প্রসঙ্গ কথায় বলা হয়েছে, “................. শিক্ষার্থীরা এদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য। সংস্কার - সংস্কৃতি, শিল্প- সাহিত্য ও নীতি নৈতিকতা সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারে এবং এ জনগোষ্ঠীর জীবনযাপন, দেশপ্রেম, মানবতাবোধ, প্রকৃতি-চেতনা, নৈতিকতাবোধ, ভ্রাতৃত্ববোধ, বিজ্ঞানচেতনা ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে ভাবতে সুযোগ পায়। শিক্ষার্থীদের সুস্থ চিন্তার চর্চা করানোই এই আয়োজনের অন্যতম উদ্দেশ্য।
এই পাঠের জন্ম ও পরিচয় অনুচ্ছেদের একটি বাক্য, ‘এপরিবারের পর্দাপ্রথা এত কঠোর ছিল যে মহিলারা ঘনিষ্ট আত্মীয় ও চাকরানী ছাড়া অন্য কোনো স্ত্রীলোকের সামনেও বের হতেন না।’
এখানে রোকেয়ার পরিবারের পর্দাপ্রথাসম্পর্কে বলা হলেও তৎকালীন সময়ে শ্রমজীবি নারী, খ্রীষ্টান নারী, হিন্দু পরিবারের কিছু নারী বাদে উচ্চবিত্ত মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো ছিল অবরোধ প্রথার অনুসারী। রোকেয়ার ‘অবরোধবাসিনী’ গ্রন্থের ঘটনাগুলো সেই সময়ের খণ্ডচিত্র। যা সেই সময়ের সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা দেয়।
শিক্ষার্থীদের সামগ্রিক সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা না দিয়ে ‘খণ্ডিতভাবে’ পরিবারকেন্দ্রিক চিন্তার ধারণা সঞ্চার কতটা যৌক্তিক? ‘খণ্ডিত’ তথ্য নিয়ে ইতিহাস-ঐতিহ্য, সংস্কার সংস্কৃতি, এ জনগোষ্ঠীর জীবনযাপন সম্পর্কে ধারণা লাভ করবে কীভাবে? এর মধ্যে দিয়ে শিক্ষার্থীরা কিভাবে সুস্থ চিন্তা করতে শিখবে?
আবার শিক্ষাজীবন অনুচ্ছেদে লেখা আছে, “পিতা বাংলা ও ইংরেজী শিক্ষার ঘোর বিরোধী বলে রোকেয়ার দিনের বেলায় পড়াশুনার সুযোগ হত না।” এই উদ্ভট তথ্যে রচনাকার কোথায় পেয়েছেন? রোকেয়া সম্পর্কে লিখতে তিনি কি রোকেয়াকে জানার চেষ্টা করেছেন? তিনি কি রোকেয়ার লেখাগুলো পড়েছেন? যদি পড়ে থাকেন তাহলে উদ্ভট তথ্যে তিনি কোথায় পেলেন? তিনি যদি রোকেয়া রচনাসমগ্র খুলে ‘লুকানো রতন’ প্রবন্ধটি পড়তেন তাহলে মনগড়া এ তথ্য লিখতেন না। ‘লুকানো রতন’ প্রবন্ধে রোকেয়া লিখেছেন, “একদিন করিমুন্নেসা গোপনে একটা বটতলার পুঁথি লইয়া অস্ফুটস্বরে পড়িতেছিলেন,-
“কোরানেতে আল্লাতালা করেছে এ মতি,
ফাদ খুলী ফী ইবাদী ওয়াদ খুলী জান্নাতী”
সেই সময় হঠাৎ তাঁহার পিতা আসিয়া পড়েন। ইহাতে তিনি অত্যন্ত ভয় পাইয়া ভাবিলেন যে, “আজ আমার সর্ব্বনাশ,-বুঝি এখনই আমাকে যমালয়ে যাইতে হইবে!” কিন্তু না, শোকর আল্হামদোলিল্লাহ্! পিতা কন্যার হাতে পুঁথি দেখিয়া রাগ করিলেন না,-বরং ভয়ে মূর্চ্ছিতা-প্রায় বালিকাকে কোলে লইয়া আদর করিলেন এবং সেই দিন হইতেই একটু একটু “সাধুভাষা”র বাঙলা পড়াইতে লাগিলেন। বাস্! আর যায় কোথা ? যত মোল্লা মুরুব্বির দল একযোগে চটিয়া উঠিলেন-“হেঁ-মেয়েকে বাঙলা পড়ান হইতেছে!” তাঁহাদের নিন্দা ও বাক্য-জ্বালায় অধীর হইয়া পিতা তাঁহার পড়া বন্ধ করিয়া দিলেন।” (পৃ: ২৩২, বা.এ.) উপরের বাক্যগুলো পড়ে কি মনে হয় রোকেয়ার পিতা বাংলা ও ইংরেজীর শিক্ষার ঘোর বিরোধী ছিলেন ? এখন প্রশ্ন হল তাঁর পিতা যদি বাংলা ও ইংরেজী শিক্ষার ঘোর বিরোধী হতেন তাহলে কি তাঁকে দায়ী করতে পারি তৎকালীন সমাজকে বিশ্লেষণ না করে? আবার ভাষা চর্চার সাথে সমাজের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থার যে সম্পর্ক তা বাদ দিয়ে ব্যক্তিকে দোষারোপ করা কতটা গ্রহণযোগ্য? উদ্ভট এই তথ্যে প্রসঙ্গ কথার উদ্দেশ্যকে কতটা বাস্তবায়নে সহায়তা করবে?
এরপর আছে, “সেজন্য রাত্রিতে পিতা ঘুমালে ভাই বোনকে পড়াতেন লিখতে শেখাতেন। এভাবে ভাইয়ের কাছে রোকেয়া গোপনে গোপনে লেখাপড়া করতে লাগলেন।”
উপরের রোকেয়ার অংশটি পড়ে বোঝা যায় যে, পিতার কারণে নয় সমাজ ব্যবস্থার কারণেই রাতের অন্ধকারে রোকেয়াকে লেখাপড়া শিখতে হয়েছে। আবার শিক্ষালাভের ক্ষেত্রে বড় ভাইয়ের অবদানের ভূমিকার কথা লেখা হয়েছে। অথচ বাদ দেয়া হয়েছে বড় বোনের ভূমিকাকে। হয়তো রচনাকার নিজেও জানেন না শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে করিমুন্নেসার অবদানের কথা। কারণ তিনি রোকেয়া সম্পর্কে ভাসা ভাসা জ্ঞান নিয়ে রচনাটি লিখেছেন। অথবা তিনি জেনেও প্রসঙ্গটি বাদ দিয়েছেন। বাদ দেয়ার কারণ পঞ্চম শ্রেণির পর্যালোচনায় ব্যাখ্যা করা হয়েছে। আবার লেখা হয়েছে, “এ সময় হতেই মুসলিম নারী সমাজের দুর্গতির কথা তাঁর মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে এবং কীভাবে তাদের দুঃখ দূর হতে পারে, সে বিষয়ে তিনি নানারূপ চিন্তা করতে থাকেন।”
সমাজের বিদ্যমান অসংগতি, সমস্যা, শিশু কিশোরদের মনোজগতে প্রভাব বিস্তার করে। ফলে শিশু-কিশোররা তাদের নিজস্ব চিন্তাশক্তি দিয়ে তার প্রভাবিত সমস্যাগুলো চিহ্নিত করার সাথে সাথে সমাধানের পরিকল্পনা করে। আর ভাবে বড় হলে সমস্যাগুলোর সমাধানের লক্ষ্যে কাজ করবে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে অর্থনৈতিক কারণে, সাংস্কৃতিক বিকাশের ক্ষেত্রে সঠিক দিক-নির্দেশনা, মতাদর্শিক বন্ধু-সঙ্গীর অভাবে অধিকাংশ শিশু-কিশোররা তাদের চিন্তার লক্ষ্যে কাজ না করে বিদ্যমান সমাজের সাথে আপোস করে। অন্যদিকে সমাজের এই ঘাত-প্রতিঘাতে কিছু মানুষের চিন্তা বিকশিত হয়। যারা সমাজের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে, উত্তরণের বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থার অসংগতি নিয়ে প্রশ্ন করে এবং সমাধানের লক্ষ্যে কাজ করে। রোকেয়া তাঁদেরই একজন।
কিন্তু উপরের পাঠের বাক্যগুলো পড়ে শিক্ষার্থীরা মনে করবে ‘রোকেয়া’ মুসলিম নারী সমাজের দূর্গতির চিন্তা করেছিলেন। তাই তিনি এ লক্ষ্যে কাজ করেছেন। শিশু-কিশোরদের মনোজগতের বিশ্লেষণ ছাড়া এই তথ্যে শিক্ষার্থীদের বিকাশে কতটা সহায়ক? আবার রোকেয়া নারীর অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে কাজ করলেও তাঁর কাজকে নারীর দুঃখ দূর করা হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করা হয়। বাক্যগুলো পড়ে শিক্ষার্থীরা তাই রোকেয়ার চিন্তার সাথে পরিচয় না হয়ে রচনাকারদের চিন্তার সাথে পরিচিত হয়। কিন্তু কেন এই প্রচেষ্টা? কারণ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে ৫ম শ্রেণির পাঠ পর্যালোচনায়।
বিবাহ অনুচ্ছেদে স্বামী শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। এ সম্পর্কে পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে।
কর্মজীবন শিরোনামের অনুচ্ছেদের এক বাক্য, “এখানে তিনি তাঁর স্বামীর স্মৃতিরক্ষার্থে একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করলেন।” জীবদ্দশায় রোকেয়াকে এরকম সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তাই তিনি পঞ্চম বঙ্গীয় নারী শিক্ষা সম্মেলনে আক্ষেপ করে বলেছেন, “এই স্কুলটা না থাকলে আমার তিলমাত্র ক্ষতি নাই। তবে এ স্কুলের উন্নতি কেন চাই ? চাই, নিজের সুখ্যাতি বাড়াবার জন্য নয়; চাই স্বামীর স্মৃতি-রক্ষার জন্য নয় ; চাই বঙ্গীয় মুসলিম সমাজের কল্যাণের জন্য। “সাখাওয়াত মেমোরিয়াল” শব্দ দুটির জন্য যদি স্কুলের অকল্যাণ হয়, তবে সাইন-বোর্ড থেকে ও শব্দ দু’টি মুছে ফেলা যাক।” (ধ্বংসের পথে বঙ্গীয় মুসলিম, বা.এ.পৃ-২৪৭)
রোকেয়া এই কথাগুলোর মধ্যে দিয়ে সেই সময়ের সমালোচকদের সমালোচনার জবাব দিয়েছেন এবং স্পষ্টভাষায় বুঝিয়ে দিয়েছেন যে তিনি সমাজের অগ্রগতির লক্ষ্যে কাজ করছেন। অথচ রচনাকার তৎকালীন সমালোচকদের সুরে কথা বলছেন। পশ্চাৎপদ চিন্তার রচনাকারদের রচনা শিশুদের চিন্তার বিকাশে কতটুকু ভূমিকা রাখবে ? তাহলে কি পশ্চাৎপদ চিন্তার উত্তরসূরি তৈরি করাই শিক্ষা কাঠামোর লক্ষ্য ?
এরপর রোকেয়াকে মুসলিম নারী জাগরণের পথিকৃৎ, মুসলিম নারী আন্দোলনের জন্মদাত্রী পরিচয় দেয়া হয়েছে। এ নিয়ে পূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে।
এরপর জাতির শ্রদ্ধা অনুচ্ছেদে একটি বাক্য, “শিক্ষা সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সমাজ সেবার ক্ষেত্রে নারীদের স্বীকৃতি প্রদানের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার ‘রোকেয়া পদক’ প্রবর্তন করেছে।” প্রশ্ন হচ্ছে কেন পুরুষদের ‘রোকেয়া পদক’ দেয়া হবে না? কারণ এর মধ্যে দিয়ে শাসকশ্রেণি রোকেয়াকে নারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং নারী-পুরুষের বৈষম্য তৈরি করেছে।
রোকেয়া সম্পর্কে না জেনে, তাঁর চিন্তা না বুঝে আজগুবি মনগড়া তথ্যে তৈরি করে, রোকেয়ার চিন্তার বিপরীত চিন্তার সমালোচকদের চিন্তাকে গ্রহণ করে রচিত হয়েছে ৭ম-৮ম শ্রেনির এই রচনা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে, এ লেখাটি জাতীয় শিক্ষা পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভূক্ত হল কিভাবে? আর পাঠ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এ রকম লেখা উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের কোন সুস্থ চিন্তার চর্চা করার আয়োজন করেছেন? পশ্চাৎপদ, কুসংস্কারচ্ছন্ন, পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিসম্পন্ন, বিজ্ঞানচেতনাহীন উত্তরসূরী তৈরি করার জন্যই কি এই আয়োজন ?
(আগামী সংখ্যায় সমাপ্ত হবে)
No comments