Header Ads

Header ADS

আমাদের শিশু সাহিত্য : আহমেদ মওদুদ

শৈশবে ভূতের ভয় তাড়িয়ে বেড়াত প্রতি মুহূর্ত। দিনের বেলায় ঝোপ-ঝাড় সংলগ্ন রাস্তা দিয়ে হাঁটতে চাইতাম না। কারণ, ভূতের ভয়। পরে যখন জ্ঞান হল বুঝতে পারলাম ভূত যতটা বনের মধ্যে ছিল তার চেয়ে অধিক ছিল মনের মধ্যে, মাথার মধ্যে। তো মাথার মধ্যে এই ভূত জিনিসটা কোত্থেকে এলো? এলো নিকটজনের কাছ থেকে শোনা বিভিন্ন কেচ্ছা-কাহিনী এবং আমাদের ভৌতিক শিশু সাহিত্য থেকে।

শিশুদের জন্য একটি গল্প বা ছড়া লেখা হবে অথচ তাতে ভূতেরআনাগোনা থাকবে না এটা আমাদের তথাকথিত, মিডিয়ার তৈরি শিশু সাহিত্যিকগণ ভাবতে পারেন না। আবার আমাদের বাজারি দৈনিকগুলোর শিশু পাতার সম্পাদকগণ বিশেষ "ভূতসংখ্যা" প্রকাশের প্রতিযোগিতায় নামেন। পারলে তারা আস্ত ভূত এনে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেন। ভাগ্যিস, বাস্তবে ভূত বলে কিছু নেই, থাকলে ওইসব সম্পাদক এবং ভোতা লেখকদের ঘাড় ভুতেরাই মটকিয়ে দিত। আমাদের মিডিয়াবাজ শিশু সাহিত্যিক যারা ইওরোপ, আমেরিকা থেকে ওহি পেয়ে শিশুদের মনস্তত্ত্বের উপর বিভিন্ন সভা-সেমিনারে শিশুসুলভ বক্তব্য দিয়ে থাকেন তারা নিজেরাও জানেন, ইওরোপ-আমেরিকার শিশু সাহিত্যিকগণ তাদের শিশু কিশোরদের জন্য ভয় পাবার উপযোগী করে কোন সাহিত্যের সৃষ্টি করেন না। কারণ, তারা ভালো করেই জানেন যে, ভয় কখনো শিশু-কিশোরদের মনোবিকাশে সহায়ক হতে পারে না। বরং ভয় যে শিশুকে মানসিকভাবে বিকলাঙ্গ করে রাখে, শিশুর মনোবিকলন ঘটায় এটা তারা বিজ্ঞান সম্মতভাবেই জানেন। তো আমাদের শিশু সাহিত্যে ভূতের এতো বাড়াবাড়ি কেন? বাড়াবাড়ি এই জন্য যে, ভূতসাহিত্যের বাজার ভালো। আর এই বাজারকে ধরে রাখার জন্য আমাদের বাজারি সাহিত্যিকগণ এই তকমা দেন যে, শিশু সাহিত্যে ভূত থাকা দরকার। তাদের এই মতামতকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য, বাজার সৃষ্টি করার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে মিডিয়া। কারণ মিডিয়া রাষ্ট্রকে খুশি রাখতে চায়। কারণ রাষ্ট্র তার জনগণকে ভয় দেখাতে পছন্দ করে। কারণ, ভয় শোষণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ জনগণ ভয় পেতে পছন্দ করে। আর জনগণের পছন্দ-অপছন্দ তৈরি করে দেয় মিডিয়া।

যে শিশুটি জীবনের শুরুতেই নিজের ভিতর কল্পনাশ্রয়ি ভূতকে লালন করে তার পক্ষে বাস্তবের ভূতকে চেনা কঠিন হয়ে পড়ে। বয়স বাড়ার পাশাপাশি সে যখন পরাবাস্তবের ভূতকে আবিষ্কার করার চেষ্টা করে ততক্ষণে তাকে গ্রাস করে ফেলে বাস্তবের পুঁজিবাদী ভূত, সাম্রাজ্যবাদী ভূত। আমাদের কথিত লেখকগণ এই বলে প্রচার চালান যে, যে ভূত, ভৌতিক গল্প শিশু সাহিত্যে স্থান পায় তা শিশুদের মনোবিকাশে সহায়তা করে। কথাটা পুরোপুরি অবৈজ্ঞানিক ও যুক্তিহীন। কারণ, ভয় কখনো মনোবিকাশের কারণ হতে পারে না বরং এর ফলে মনোবিকলন ঘটার সম্ভাবনাই বেশী।

আমাদের চলতি শিশু সাহিত্যিকগণ আর একটা বিষয়কে বেশ ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার করেন যে, শিশু সাহিত্যে দুঃখ, শোক থাকতে নেই। কথাটা অযৌক্তিক এবং ভুল। এটা পুতুপুতুমার্কা সাহিত্য রচনার জন্য বেশ উপযোগী কথা। এই কথা বলে বাস্তব থেকে দূরে থাকা যায়। বেশ আরাম করে সাহিত্য রচনা করা যায়। এইসব আয়েশি সাহিত্যিকদের ভাষায়, শিশু সাহিত্যে অভাব-অনটনের কথা, শোকের কথা, দুঃখের কথা থাকতে নেই। তাহলে নাকি তাদের হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়ে যায়। তারা জুস, ফাস্ট ফুডের বিভিন্ন আইটেম মন দিয়ে খেতে চায় না। বিষয়টির সাথে আমাদের দেশে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থাটা বেশ মানিয়ে যায়। এখানে যেমন এগার রকম শিক্ষা ব্যবস্থা চালু আছে তেমনি চালু রাখতে হবে এগার-বারো রকম শিশু সাহিত্য। থাকবে কিন্ডার গার্ডেন সাহিত্য, ইংলিশ মিডিয়াম সাহিত্য, এবতেদায়ী সাহিত্য ইত্যাদি। বস্তির শিশু কিংবা প্লাটফর্মের শিশুকে নিয়ে সাহিত্য রচিত হতে পারবে না। কারণ সে সাহিত্য পড়লে উপর তলার শিশুরা যদি দুঃখ পায়, যদি তারা উপর থেকে মাটির দিকে নেমে আসতে চায়, তাই তাদের অভিভাবকরা তাদের শিশুদের দুঃখ-কষ্ট আছে এমন সাহিত্য পড়াতে চায় না। আর যেহেতু এই সাহিত্যের বাজার নেই সেহেতু আমাদের শিশু সাহিত্যিকগণ এই মত প্রকাশ করেন যে, শিশু সাহিত্যে অভাব-অনটন থাকতে নেই। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, সাহিত্য যখন জীবনরই প্রতিচ্ছবি তখন সুবিধা বঞ্চিত দরিদ্রতম শিশুটির জীবনের গল্প কেন সাহিত্যে থাকবে না? কেন তার জীবনের গল্প উপর তলার সুবিধাভোগী অন্য একটা শিশু জানতে পারবে না? পারবে না এই জন্য যে, অকল্যাণ রাষ্ট্র বরাবরই শ্রেণী বৈষম্য বজায় রাখতে সচেষ্ট থাকে আর গৃহপালিত লেখক, বুদ্ধিজীবীরা সচেষ্ট থাকে তাদের লেখনির দ্বারা রাষ্ট্রকে খুশি রাখতে।

ইদানিং সায়েন্স ফিকশন অভিধায় যে সাহিত্য রচিত হচ্ছে তা এই হতভাগা দেশের শিশু-কিশোরদের শেকড় থেকে বিচু্যত করা ছাড়া আর কিছুই নয়। যে দেশের মানুষ এখনো অভুক্ত থাকে, যে দেশের কৃষি ব্যবস্থা এখনো অবৈজ্ঞানিক, যেখানে কী শিক্ষা, কী স্বাস্থ্যে মানুষ এখনো সনাতনী সে দেশের পাঠককে মহাশূণ্যের গল্প শোনানো আর জনগণকে অভুক্ত রেখে রাষ্ট্রীয়ভাবে মহাকাশ গবেষণা কিংবা সমরাস্ত্রের মজুত বাড়ানো একই কথা। এই সায়েন্স ফিকশন যে কাজটা করে সেটা হচ্ছে, আমাদের শিশু-কিশোরদের মাটির গন্ধ চেনাবার আগে মহাকাশের দিকে ধাবিত করার ক্ষেত্রে অনুপ্রাণিত করে আর একটা পর্যায়ে এরা গিয়ে মাধ্যাকর্ষণে আটকা পড়ে। তখন এরা না চিনতে পারে মহাকাশ না বুঝতে পারে মাটিকে। অন্যদিকে সায়েন্স ফিকশনের ঘোর থেকে বেড়িয়ে এসে উন্নত রাষ্ট্রের সেবকগণ আমাদের বাচ্চাদের বিস্কুট খাইয়ে সাঁতার কাটতে দেশিয় ফুল, পাখি, গাছ চিনতে সাহায্য করে। পক্ষান্তরে আমাদের শিশু সাহিত্যিকগণ সাহায্য করে ভূত চিনতে, ইটি চিনতে, সিটি চিনতে।

একটা কথা স্বীকার্য যে রূপকথা (ভূত, পেতি্ন, রাক্ষস মাত্রই রূপকথা নয়) শিশু-কিশোরদের কল্পনার জগতকে অনেকাংশই বিস্তৃত করে। সেক্ষেত্রে রূপকথার উপাদান হতে পারে ফুল, পাখি, পরি কিংবা মিথ বিশেষ। তবে এর পাশাপাশি শিশু-কিশোরদের তাদের পরিপাশর্্বকে চেনানোও জরুরী। তাহলে জীবনের অনেকগুলো সময় পাড়ি দিয়ে পারিপাশ্বর্িক সত্যের মুখোমুখি হয়ে হোঁচট খেতে হয় না তাদের। আর এজন্য প্রয়োজন সময়োপযোগী, বস্তুনিষ্ঠ শিশু সাহিত্যের বিকাশ যা কেবল প্রকৃত শিশু সাহিত্যিকগণের দ্বারাই সম্ভব। তবে এই সাহিত্যিক মিডিয়ার পেছনে না ঘুরে শিশুদের পেছনে, আশে পাশে ঘুরে তার কাজটি করবেন।

No comments

আমাদের ঠিকানা

রংপুর।, Bangladesh
বিজ্ঞানচেতনা পরিষদ, টাউন হল চত্বর, রংপুর। মোবাইলঃ ০১৭১৯৪৬৩৫৪১, ০৭১৪৬০৭০৬৩৪, ০১৭৩৮২৮০২০১। E-mail: muktochintabcp@gmail.com
Powered by Blogger.