মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কি অবসান হচ্ছে? (পর্ব ১) : রিচার্ড বি. ডিউক বফ
ব্রিটেন পৃথিবীকে ১৮১৫ থেকে ১৯১৩ সাল পর্যন্ত শাসন করেছে কিন্তু ১৮৯০ এর শেষে সে আমেরিকা ও জার্মানীর অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝে পড়ে ব্রিটেনের পক্ষে আর বিশ্বকে অধিকার করে রাখা সম্ভব হলো না। আমেরিকার আধিপত্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে শুরু হয় এবং ৩০ বছর পরে ডালপালা ছড়িয়ে মহীরুহে পরিণত হয়। এখনও আমেরিকা বিশ্বের অর্থনীতি ও রাজনীতিতে মহাশক্তিধর। কিন্তু এই সুপার পাওয়ার পৃথিবীর বিভিন্ন ঘটনাকে প্রভাবিত ও আয়ত্বে আনার ব্যাপারে দিন দিন দূর্বল হয়ে পড়ছে। আমেরিকার সেনাবাহিনীর ক্ষমতার সাথে এর অর্থনীতি ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির তাল মিলছে না এবং আমেরিকার পুঁজি সংকটাপন্ন। এমনকি, আমেরিকার স্বর্ণযুগেও (১৯৪৪-১৯৭১) তার ভিয়েতনামে পরাজয় ও কোরিয়ায় সমঝোতা ঠেকাতে পারেনি।
১৯৭০ থেকে আমেরিকার অর্থনীতির নিম্নমুখী যাত্রা/ক্রমাবনতি আমেরিকার অর্থনৈতিক শক্তির ক্রমাবনতিকে আমরা কিছু উদাহরণের মাধ্যমে তুলে ধরব-
(১)
ঙ্ ১৯৫০ সালে বিশ্বের মোট উৎপাদনের ৫০% যোগান দিয়েছে আমেরিকা। এখন ২১% যোগান দিতে পারে। ১৯৫০ সালে কারখানায় উৎপাদিত পণ্যের ৬০% এর যোগান দিত আমেরিকা এখন যা দাঁড়িয়েছে ২৫% এ। ব্যবসায়িক সেবার রপ্তানী এখন পৃথিবীতে একটি উঠতি ব্যবসা। ২০০১ সালে এই ব্যবসায় আমেরিকার অংশ ছিল ২৪%, যেখানে ইউরোপিয়ো ইউনিয়নের অংশ ছিল ২০%। আন্তঃ বাণিজ্যকে ধরলে দাঁড়াত ৪০% এ।
ঙ্ নন-আমেরিকান কোম্পানীগুলো ২০০২ সালে ছিল সবচেয়ে প্রভাবশালী। পৃথিবীর ১০টা সর্ববৃহৎ ইলেকট্রনিঙ্ এবং ইলেকট্রিক্যাল যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকারী কোম্পানীর ৯টা ছিল তাদের। ১০ টার মধ্যে ৮টি সর্ববৃহৎ গাড়ী নির্মাতা কোম্পানী; দশে সাতটা পেট্রোলিয়াম শোধনাগার, দশে ছয়টা টেলিযোগাযোগ কোম্পানী, দশে পাঁচটা ঔষধ নির্মাতা ফার্ম; ৬টা রাসায়নিক দ্রব্য উৎপাদনকারীর মধ্যে ৪টা; ৭টা বৃহৎ এয়ারলাইনসের মধ্যে ৪টা ছিল তাদের। বিশ্বের সর্ববৃহৎ ২৫টা ব্যাংকের মধ্যে ১৯ টা নন-আমেরিকান ব্যাংক।
ঙ্ ২০০১ সালে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সম্পত্তির পরিমাণের ভিত্তিতে ১০০ বৃহৎ কর্পোরেশনের মধ্যে আমেরিকান কর্পোরেশনের সংখ্যা ছিল ২৩। যৌথভাবে জার্মানী, ফ্রান্স, ইউকে এবং নেদারল্যান্ডস, যাদের জিডিপি আমেরিকার সাত-দশমাংশ তাদের কর্পোরেশনের সংখ্যা ছিল ৪০ টা। জাপানের ছিল ১৫ টা। ১৯৯০ সালে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ১০০ মাল্টিন্যাশনালের ভিতর আমেরিকার বৈদেশিক বিক্রির পরিমাণ কমেছে ৩০% থেকে ২৫% পর্যন্ত; অন্যদিকে ইইউ নির্ভর মাল্টিন্যাশনালগুলোর বিক্রির পরিমাণ ৪১%-৪৬% বেড়েছে।
২০০১ সালে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মোট প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের ২১% ছিল আমেরিকান অথচ ১৯৬০ সালে ছিল ৪৭% শেয়ার। ১৯৯৬-২০০১ সময়কালে নতুন প্রত্যক্ষ বিনিয়োগে আমেরিকার অংশ ১৭%। ব্রিটেন থেকে এসেছে ১৬% এবং যৌথভাবে ফ্রান্স ও বেলজিয়াম-লুঙ্মেবার্গ যোগান দিয়েছে ২১% শেয়ার।
১৯৯৮-২০০০ সালে আমেরিকিার ২৫টা বড় মার্জারস্ এন্ড এ্যকুইজিশন এর মধ্যে ৫টার মালিকানা অন্যদেশের মাল্টিন্যাশনালদের হাতে হস্তান্তরিত হয়েছে(৩টা বিট্রিশ, ২টা জার্মান)। ১৯৮৭-২০০১ পর্যন্ত সর্ববৃহৎ ২০টা কর্পোরেশনের যারা বিভিন্ন দেশের মার্জরস্ এন্ড এ্যকুইজিশন (গ্অঝ) এ জড়িত তার মাত্র দু'টো আমেরিকান কোম্পানী (জেনারেল ইলেকট্রিক ও সিটি গ্রুপ) এবং তারা সমস্ত গ্অঝ ব্যবসার মাত্র ৫% এর অংশীদার।
বৈশ্বিক অর্থায়নে আমেরিকা আর প্রাধান্য বিস্তারকারীর অবস্থান ধরে রাখতে পারছে না। ডলারের প্রতিপত্তি ১৯৭০ সাল থেকে কমে যাচ্ছে বিশ্বের অন্যান্য প্রধান মুদ্রার চেয়ে, কিছু কিছু বিশেষ বিশেষ পর্যায়ে ডলারের পুনরুজ্জীবন ছাড়া। ১৯৮১-১৯৯৫ সালের ব্যক্তিগত সঞ্চয়েল মধ্যে ইউরোপীয়ান মুদ্রায় শেয়ার বেড়েছে ১৩%-৩৭% পর্যন্ত যেখানে ডলারের শেয়ার ৬৭%-৪০% এ এসে ঠেকেছে। ১৯৯৯, যখন থেকে ইউরো চালু হয় তখন থেকেই বিশ্বের নতুন বন্ডগুলোর ৪৪% ইউরোতে ইসু্য করা হয়। ৪৮% ইসু্য করা হয় ডলারে। ১৯৯০ সালে ওয়ার্ল্ড সেন্ট্রাল ব্যাংকে অর্ধেক পরিমাণ বৈদেশিক বিনিময় সঞ্চয় ডলারে করা হয়েছে যেখানে ১৯৭৬ সালে করা হয়েছিল ৭৬%। (২)
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বৈশ্বিক অর্থনীতিতে আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য দ্বিতীয় মুদ্রার প্রচলন শুরু হল এমন এক সময়ে যখন ইন্টারন্যাশনাল পেমেন্টের ব্যালান্স রেকর্ড পরিমাণ ঘাটতি থাকছে।
৭৮ বছরের রেকর্ড ভেঙ্গে ১৯৭১ সাল থেকে, আমেরিকার পণ্য বাণিজ্যে ঘাটতি হচ্ছে। রপ্তানী আমদানীকে ছাড়িয়ে গেছে শুধুমাত্র ১৯৭৩ এবং ১৯৭৫ সালে। পণ্য আমদানী রপ্তানির চেয়ে বেশী হলেও একটা জাতি অন্যান্য দেশের সাথে ভারসাম্যপূর্ণ চুক্তির মাধ্যমে টিকে থাকতে পারে। পণ্য আমদানী রাপ্তানী বাণিজ্যে ঘাটতি থাকলেও তা পুষিয়ে নেয়া যায় যদি বিদেশে সেবা বিক্রিতে (আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ইন্সুরেন্স, টেলি কমিউনিকেশন, বিজ্ঞাপন এবং অন্যান্য ব্যবসায়িক সেবা) ভালো আয় (লাভ, ডেভিডেন্টস, সুদ, রয়ালিটিজ ইত্যাদি) হয়। কিন্তু আমেরিকার ঘাটতি এতই বেশী যে অন্যান্য দেশে সার্ভিস বিক্রি এবং বিনিয়োগের রেমিট্যান্স দিয়ে ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব হয় না। আমেরিকার এ্যাকাউন্ট , পণ্য বাণিজ্য, সার্ভিস এবং বৈদেশিক বিনিয়োগের থেকে আয়ের যোগফল মিলে) ১৮৯৫-১৯৭৭ পর্যন্ত উদ্বৃত্ত ছিল এখন যা দ্রুত কমছে। বাণিজ্যিক ঘাটতি এত বেশী হচ্ছে যে, বিদেশে সেবা বিক্রির টাকা থেকে তা পূরণ করা যাচ্ছে না। ১৯৯০ থেকে আমেরিকায় বৈদেশিক বিনিয়োগ দ্রুত বাড়ছে যেটা অন্যান্য দেশে আমেরিকার বিনিয়োগের তুলনায় বেশী।
২০০২ সালে, প্রথমবারের মতো আমেরিকার ব্যালান্স নেগেটিভ হয়ে গেল যার ফলে আমেরিকা এখন বিদেশীদের বেশী বিনিয়োগ আয় দিচ্ছে তাদের বিনিয়োগ আয়ের চেয়ে।
আয় ও ব্যয়ের মধ্যে পার্থক্যে ঘাটতি পূরণ করা হয় ধার করে। ২০০২ সালে আমেরিকা ৳ ৫০০ বিলিয়ন অন্য দেশ থেকে ধার করেছে, যা তাদের জিডিপির ৪.৮%। বিদেশীরা যখন আমেরিকানদের (ব্যক্তি, কোম্পানী, সরকার) কাছ থেকে ব্যবসা করে ডলার পায়, তারা সেটা আমেরিকান সম্পত্তি (ইউএস ট্রেজারী বন্ড, কর্পোরেট বন্ড এবং স্টক কোম্পানী ও রিয়েল এস্টেট) কিনে ব্যয় করতে পারে। এইসব কারণে আমেরিকা ১৯৮৬ সাল থেকে ঋণগ্রস্ত জাতি বনে গেছে। আমেরিকাতে এখন বৈদেশিক মালিকানায় সম্পত্তির পরিমাণ ৳ ২.৫ ট্রিলিয়ন যেটা আমেরিকার বৈদেশিক সম্পত্তির চেয়ে বেশী। ২০০৩ এর মাঝামাঝি বিদেশীরা সমস্ত ট্রেজারী মার্কেটেবল ডেট এর ৪১%; কর্পোরেট বন্ডের ২৪% এবং কর্পোরেট স্টকের ১৩% এর মালিক ছিল। আমেরিকার কোম্পানীগুলো অন্যান্য দেশে এখনও বিনিয়োগ করছে কিন্তু আগের মতো পারছে না, ব্রিটেনের যেমন সঞ্চয় উদ্বৃত্ত ছিল জিডিপির ৩%-৪% ১৮৫০-১৯৯১ পর্যন্ত যখন সেবাবিক্রি এবং বৈদেশিক বিনিয়োগ আয় মার্চান্ডাইজ বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণের চেয়ে বেশী ছিল। (৩)
যতদূর মনে হয়, আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীরা আমেরিকার আভ্যন্তরীণ ঘাটতিতে বিনিয়োগ করার ব্যাপারে আগ্রহী কিন্তু এটা চিরকালের জন্য না। ডলারের উপর ঘাটতির বিরূপ প্রভাব পড়েছে, সন্দেহ করা হচ্ছে যে, আমেরিকা তার ফুলে ওঠা ঘাটতি পোষানোর জন্য কম দামে ডলার ছাড়বে। বাড়ন্ত বাণিজ্যিক ঘাটতিতে ডলারের মান যতই পড়ছে, ততই বিদেশী বিনিয়োগ কমাচ্ছে। জার্মানী অফিস সম্পত্তির বিনিয়োগের ক্ষেত্র ২০০৩ সালে নিউইয়র্ক সানফ্রান্সিসকো এবং আমেরিকার অন্যান্য অঞ্চল থেকে ফিরিয়ে নিচ্ছে। বাড়ী ভাড়া কমছে যখন ডলার ইউরোতে পরিণত করা হচ্ছে এবং বিল্ডিংগুলো ইউরোতে যেখানে কম দামে পাওয়া যাচ্ছে।
"আমরা ব্রিটেন এবং নরডিক দেশগুলোতে যখন একই রকম লাভ পাচ্ছি তখন কেন আমেরিকা যার যেখানে মুদ্রার ঝুঁকি অনেক বেশী" বলেছেন মিউনিখ নির্ভর সম্পত্তির অর্থায়নের প্রধান বিনিয়োগ অফিসার। (৪) সামপ্রতিক সময় পর্যন্ত ওপেক ভুক্ত দেশগুলো তাদের তেল বিক্রি করত শুধুমাত্র ডলারে। ইরাক ইউরোতে টার্ন করে ২০০০ সালে (ইউরো বিষয়ক কুসংস্কার ভাঙ্গে ২০০৩ সালে) এবং ইরান ১৯৯৯ সাল থেকে আলোচনা চালিয়ে যায় যখন থেকে ইউরো চালু হয়েছিল। ২০০২ সালের এপ্রিলে সেপনে এক বক্তৃতায় ওপেক এর মার্কেট অ্যানালাইসিস ডিপার্টমেন্টের প্রধান জাভেদ ইয়ারজানি পরিবর্তনের এক ক্ষুদ্র সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছেন। "নিকট ভবিষ্যতে....(কিন্তু) দূরবর্তী সময়ে ইউরো ডলারের বিপরীতে অপকারী হবে না। ইউরো জোন আমেরিকার চেয়ে বৈশ্বিক বাণিজ্যের বড় শেয়ারের অংশীধার এবং ......ভারসাম্যপূর্ণ আন্ত-মুদ্রা পরিস্থিতি। ইউরোতে অভ্যস্ত হওয়া ইউরোপের প্রধান তেল উৎপাদনকারী দেশ নরওয়ে এবং বৃটেন তৈরী করতে পারে এমন মুহূর্ত যা তেল বিক্রির ব্যবস্থা ইউরোতে প্রবর্তণ করতে পারে।" ইয়ারজানি তাঁর বক্তব্য শেষ করেছেন এইভাবে, "ওপেক ভবিষ্যতে ইউরো মুদ্রা ব্যবস্থা ও প্রদানের ব্যবস্থার সম্ভাবনাকে নাকচ করছে না।"
যদি বিদেশী বিনিয়োগকারীরা আশানুরূপ ফল না পায়, তারা ইউএস শিল্পগুলোতে বিনিয়োগ বন্ধ করবে, অথবা তাদের ডলারের সম্পত্তি বিক্রি করবে। ফলে, ডলারের মান দ্রুত পড়বে, এবং আমেরিকায় সুদের হার অবশ্যই দ্রুত বেড়ে যাবে। টাকা ধার করা কঠিনতর হবে এবং ভোক্তাদের আমদানী করা পণের জন্য বেশী টাকা গুণতে হবে, অন্য দ্রব্য কেনার জন্য আয়ের অপায় হবে এবং অর্থনীতি মন্দার ভিতর পড়বে। ডলারের মান কমে যাওয়ায় ওয়াল স্ট্রিটকে ঝুঁকিপূর্ণ করে আমেরিকান স্টক ও বন্ডগুলোকে বিক্রি করে দেবে। বিভিন্ন ঘটনার কারণে ডলার এখন ইউরোর তুলনায় ঝুঁকিপূর্ণ মুদ্রায় পরিণত হয়েছে এবং সম্ভবত আরো দুই বা তিনটি মুদ্রার চেয়ে (ইয়েন, স্টারলিং, সুইস ফ্রাঙ্ক)। (চলবে)
No comments