Header Ads

Header ADS

সাক্ষাৎকার “...অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক-মতাদর্শিক মুক্তিই নারীকে সত্যিকার অর্থে মুক্তি দিতে পারবে। ” আনু মুহাম্মদ

অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ একাধারে অর্থনীতিবিদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সম্পাদক ও জাতীয় তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিবসরকার ঘোষিত নারী উন্নয়ন নীতিনিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে যে আলোচনা-সমালোচনা ও বিতর্কের সৃষ্টি হয় এর প্রেক্ষিতে নারী, নারী প্রশ্ন, নারী মুক্তি এবং নারী উন্নয়ন নীতির আদ্যপান্ত বুঝতে মুক্তচিন্তার পক্ষ থেকে সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করা হয়সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেন বিজ্ঞানচেতনা পরিষদ কারমাইকালে কলেজ শাখার কর্মী সোহাগ এবং রায়হান

মুক্তচিন্তাঃ নারী উন্নয়ন নীতি বলতে আমরা কি বুঝব?
আনু মুহাম্মদঃ সরকার এর নাম দিয়েছে নারী উন্নয়ন নীতিএখানে উন্নয়নশব্দটা একটা বাহুল্য শব্দএটা নারী নীতি হতে পারতনারী নীতিবলতে সাধারণভাবে বোঝা যায় একটা রাষ্ট্র নারী সম্বন্ধে কি নীতিমালা অবশ্য পালণীয় বলে মনে করেসমাজে, অর্থনীতিতে, রাজনৈতিক অবস্থানে সাংবিধানিকভাবে নারীর অবস্থানটা সুনির্দিষ্ট করা এবং সে অনুযায়ী কমসূচী নির্ধারণ করাটাই হচ্ছে নারী নীতিএখানে উন্নয়ন শব্দটা যুক্ত হওয়ার কারণ হচ্ছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে বাংলাদেশ সরকার প্রতিনিধিত্ব করে এবং নারী বিষয়ে জাতিসংঘের বিভিন্ন কর্মসূচী আছেএর মধ্যে সিডওএকটিসিডওহচ্ছে নারীর বৈষম্য নিরসনে একটি আন্তর্জাতিক নীতিমালা যেটা জাতিসংঘে গৃহীত হয়েছেতারপরে বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনের কিছু নীতিমালা যেমন বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন যেটা বেইজিং প্লাসনামে পরিচিত সেখানে কিছু নির্দিষ্ট বিধান আছেএগুলোর ব্যাপারে প্রত্যেক রাষ্ট্রের কিছু বাধ্যবাধকতা আছেবাধ্যবাধকতা মানে এইগুলি আইনি বাধ্যবাধকতা নয়কোন রাষ্ট্র যদি না মানে তার জন্য অসুবিধা হবে নাকিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা তৈরির জন্য কিছু নূন্যতম নীতিমালা গ্রহণ করেছে কিনা সেটা জবাবদিহীতার প্রশ্ন আসে আন্তর্জাতিক এ সমস্ত ফোরামেএটা হচ্ছে একটা দিক যেটা নারী বিষয়ে কার্যকর কিছু গ্লোবাল অ্যাকশনের চাপ বা বাধ্য বাধকতাঅন্য আরেকটি দিক হচ্ছে যেমন বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক কিংবা অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা যারা ফিন্যান্স করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে, ফিন্যান্স করার ক্ষেত্রে তারা তাঁদের নিজ নিজ দেশে নারী বিষয়ক যে তৎপরতা আছে সেটার চাপে নারী বিষয়ে জেন্ডার পলিসি গ্রহণ করেজেন্ডার পলিসি থাকার কারণে তারা জেন্ডার ডেভেলপমেন্ট, উইমেন ডেভেলপমেন্ট এ সমস্ত শব্দগুলি ব্যবহার করেসেখানে এনজিও যারা আছে তাদের কার্যক্রমের মধ্যেও এটা থাকেতো সেটার একটা প্রভাব দৃষ্টিভঙ্গির  মধ্যে কিংবা অ্যাপ্রোচের মধ্যে পড়েএই দুইটার প্রভাব এবং চাপে কিংবা বাধ্যবাধকতা থেকেই বাংলাদেশ সরকার গত দশ বছর কিংবা আরো বেশি সময় ধরে যেমন ১৯৯৭ সাল থেকে এটা নিয়ে কথাবার্তা বলছে কিংবা নীতিমালা তৈরির একটা তাগিদ তৈরি হয়েছেসেখান থেকেই এই নারী উন্নয়ন নীতিআবার আমরা যদি নিজেদের রাজনৈতিক তাগিদ বা অবস্থান পরিষ্কার করার কথা চিন্তা করি তাহলে নারী নীতিইযথেষ্ট
মুক্তচিন্তাঃ বর্তমানে প্রস্তাবিত নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১সম্বন্ধে কিছু বলুন
আনু মুহাম্মদঃ বর্তমানে ঘোষিত নারী উন্নয়ন নীতিকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়প্রথম অংশে যেটা আছে সেটা একধরনের আতœস্তুতি ধরনেরএই অংশে বর্তমান সরকার এবং আগের সরকারগুলো নারী বিষয়ক কী কী উদ্যোগ নিয়েছে সেটার একটা বিবরণ আছেসে হিসাবে বর্তমান সরকার তার আগের সরকারগুলোর পক্ষেও কিছু কথাবার্তা বলেছে মানে এই সরকারগুলি কী কী করেছে সেটা নিয়ে একটা জবাবদিহিতা ধরনেরএকটা আন্তর্জাতিক ফোরামে উপস্থিত হলে যেটা দরকার, যেমন- আমরা অনেক কাজ করেছি তার মধ্যে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ আইন থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের বরাদ্দ টরাদ্দ এ সমস্ত কথাবার্তাএই অংশটা পড়লে অনেকের মনে হতে পারে বাংলাদেশের নারীর যে সমস্ত সমস্যা সেগুলির সমাধানের জন্য রাষ্ট্র বা সরকার অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে ফেলেছেএবং তারপরে এরকমও মনে হতে পারে যে, তাহলে আর আলাদা করে নারী নীতির কি দরকার? কারণ এত বেশি অতিরঞ্জিত করে, ফুলিয়ে ফাপিয়ে বলা হয়েছে এবং অন্যান্য সরকারগুলোর সময়কেও যেভাবে মহিমান্বিত করা হয়েছে তাতে মনে হবে যে, বাংলাদেশের নারীর অবস্থা খুবই ভালোশুধুই সাফল্যের গাঁথা!
দ্বিতীয় অংশটা হচ্ছে, সেখানে কিছু স্টেটমেন্ট, কিছু সদিচ্ছার প্রকাশ বা সাধারণভাবে কিছু দৃষ্টিভঙ্গিগত বক্তব্য উপস্থিত করা হয়েছেযেমন কন্যাশিশুর নিরাপত্তা, নারী-পুরুষের সমানাধিকার, নারীর নিরাপত্তা ইত্যাদি নিশ্চিত করাযেগুলির বেশিরভাগের সঙ্গে কিছু দুর্বৃত্ত বাদে সকলেই একমত হবেনকিন্তু সুনির্দিষ্টকরণ করা যাকে বলে, সেগুলির বিষয়ে ব্যবস্থাগ্রহণ বা সরকার কী কী করবে, সে বিষয়ে সুস্পষ্ট বক্তব্য নাইযেমন ছয় মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি, এ বিষয়ে বিতর্কের কিছু নাই এবং এটার জন্য নারী নীতিরও দরকার নাইসরকার যেকোন সময় সিদ্ধান্ত দিয়ে দিতে পারে ছয় মাসের ছুটি বোধহয় দিয়েও দিয়েছেআর একটা যেমন শিশুদের জন্য প্রত্যেকটা জায়গায় ডে-কেয়ার সেন্টার করাএজন্য সরকার কিন্তু নির্দেশনা দিয়ে দিতে পারে সকল প্রতিষ্ঠানকেএটা একটা খুবই প্রয়োজনীয় কাজতারপরে একটা জিনিস নাই কিন্তু খুবই গুরুত্বের সাথে থাকা উচিত ছিল সেটা হল পাবলিক টয়লেটঢাকা শহরে নারী শ্রমিক এমনকি মধ্যবিত্ত নারীদেরও এটা একটা বড় ধরনের সংকটযেটা সরকার যেকোনো সময় সিদ্ধান্ত নিয়ে সে অনুযায়ী বরাদ্দ দিতে পারেএখানে সাধারণ কিছু বক্তব্য এবং সেখানে অর্জিত সম্পত্তির উপর সমানাধিকার এই ধরনের কথাবার্তা আছেকিন্তু যেটা নিয়ে বিতর্ক সে ধরনের কথাবার্তা দ্বিতীয় অংশে কেন কোন অংশেই নাই সেটা হল উত্তরাধিকারে নারীর সমানাধিকারএটা নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে কিংবা বড় ধরনের একটা প্রতিরোধ হচ্ছে সমাজের থেকে, ধর্মীয় কিছু গোষ্ঠী থেকেযার ফলে খুবই অনির্দিষ্ট এবং কিছু সদিচ্ছা কিংবা কিছু বক্তব্য সাধারণ কিছু নীতিমালা এইসব কথাবার্তা দ্বিতীয় অংশে আছে
তৃতীয় অংশে যেটা আছে, তাতে সর্বোপরি মানুষের জন্য বিশেষ করে নারীদের জন্য বিপদের অনেকগুলো কথা আছেসেটা হল, বর্তমান উন্নয়ন নীতিতে নারীর অংশিদারিত্ব বাড়ানো বা নারীর জন্য নিরাপত্তা জাল বা সেফটিনেট যে প্রোগ্রাম আছে সেখানে নারীর যাতে আরো অধিকার সুনিশ্চিত হয় সেটা সম্পর্কে বলা হয়েছেএখানে এই তৃতীয় অংশটা একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে বর্তমান যে উন্নয়ন নীতি দ্বারা বাংলাদেশ পরিচালিত হচ্ছে সেই উন্নয়ন নীতিটা গ্রহণ করে নারীর অবস্থানকে ওর মধ্যে সুনির্দিষ্ট করার কথা বলা হয়েছেএই জায়গাতেই বড় সমস্যাযে উন্নয়ন নীতি দ্বারা বর্তমানে বাংলাদেশ পরিচালিত হচ্ছে তার দ্বারা পুরো বাংলাদেশের সকল মানুষই বিপদগ্রস্ত, কতিপয় দুর্বৃত্ত কিংবা শাসকশ্রেণী ছাড়াসকল মানুষের জীবনই বিপর্যস্ত—, তারমধ্যে অধিকতর বিপর্যস্তহচ্ছে নারীকারণটা কি? কারণ বর্তমান উন্নয়ন নীতির মূল দিকগুলি কি? মূল দিকগুলি যেমন আমি যদি বলি বাংলাদেশের জাতীয় সম্পদ বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া বা প্রাইভেটাইজেশন করা যেটা বর্তমান উন্নয়ন নীতি অনুযায়ী চলছেএর ফলাফল কি? এর ফলাফল হচ্ছে গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়া, বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাওয়া, জাতীয় কর্তৃত্ব হরণ হওয়া, কর্মসংস্থানের সুযোগ সংকুচিত হওয়া, শিল্পায়ন বাধাগ্রস্ত হওয়াসেগুলি হলে কি হয়? সমস্ত জিনিসের দাম যদি বেড়ে যায়, কর্মসংস্থান যদি কমে যায়, জাতীয় মর্যাদা যদি লুন্ঠিত হয়, সেগুলির মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হয়কিন্তু নারীর ক্ষতিটা হয় সবচেয়ে বেশিতারপরে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণপাবলিক এডুকেশন থেকে এটা ক্রমান্বয়ে প্রাইভেট এবং কমার্শিয়ালাইজড করা বর্তমান উন্নয়ন নীতির অন্যতম দিকএটা করলে কি হয়? শিক্ষাক্ষেত্রে যদি ব্যয় বৃদ্ধি পায়, দেখা যায় একটা বড় অংশের মানুষ শিক্ষার সুযোগ পায় না তখন সীমিত আয়ের মানুষদের বাছাই করতে হয়, অগ্রাধিকার ঠিক করতে হয়, যদি তার ছেলে এবং মেয়ে থাকে তাহলে কার জন্য সে টাকা খরচ করবে? এই বাড়তি খরচের প্রশ্ন এলে ছেলে প্রায়োরিটি পায় এবং মেয়েদের অনেকের শিক্ষা বন্ধ হয় ফলে তারা মেধা কাজে লাগাতে পারে নাআবার চিকিৎসা যদি বাণিজ্যিকীকরণ হয়, বেসরকারিকরণ হয়, চিকিৎসা ব্যয় বেড়ে যায়চিকিৎসা ব্যয় বেড়ে গেলে যেটা হয়, মেয়েদের চিকিৎসা করার যে প্রয়োজন বা তাগিদ সেটা কমে যায়এমনিতেই পরিবারগুলোর মধ্যে সবচেয়ে নিচে থাকে এটা এবং বাংলাদেশের অনেক মা আছে, তরুণী মা থেকে শুরু করে বৃদ্ধা পর্যন্ত অনেক মা আছে যারা নিজেদের জটিল অসুস্থতার খবরও তাদের পরিবারে উপস্থিত করে নাউপস্থিত করে না এই কারণে যে, তার জন্য যে খরচ এই খরচ বহন করার ক্ষমতা এই পরিবারের নাই এবং না বলে বলে দেখা যায় যে, অসুখ জটিল হয় এবং সারা জীবন ভুগতে ভুগতে হয়তো মারা যায়এরকম অবস্থা আরো কঠিন আকার ধারন করে যখন পাবলিক হেলথ ট্রিটমেন্ট পুরোপুরি বিপর্যস্ত হয়ে যায়, মানুষকে নির্ভর করতে হয় অনেক বেশি ব্যয়বহুল চিকিৎসা ব্যবস্থার উপরএই ধরনের নীতিমালাগুলোই চলছেতার সঙ্গে সঙ্গে গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন শিল্পখাত যেগুলো গড়ে উঠছে সেখানে ট্রেড ইউনিয়ন রাইট নাই, মজুরির কোনো নিয়ন্ত্রণ নাই, জব সিকিউরিটি নাইএই উন্নয়ন নীতির অংশ হিসেবে এগুলি যখন চলছে তখন নারীর নিরাপত্তাহীনতা প্রতি মুহূর্তে তৈরি হচ্ছে, তার বঞ্চনা তৈরি হচ্ছে, তার অর্থনৈতিক, সামাজিক, পারিবারিক চাপ তৈরি হচ্ছেফলে এই উন্নয়ন নীতি বহাল রেখে তারপরে যদি বলা হয় যে, তাকে সেফটিনেটের মধ্যে আনা হবে সেটা একটা প্রহসন ছাড়া আর কিছুই নয় এবং কি পরিমাণ প্রহসন সেটা আমরা কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা থেকে দেখছি এবং এটা বহাল রেখেই কিন্তু নারী উন্নয়ন নীতির সমানাধিকারের কথা বলা হচ্ছেফলে পুরো জিনিসটাই একটা প্রহসনমূলক হয়ে যায় এই হলো বর্তমান নারী উন্নয়ন নীতি
মুক্তচিন্তাঃ নারী নীতিপ্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অন্য উন্নত দেশগুলোর অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে কিছু বলুন
আনু মুহাম্মদঃ অন্যান্য যে সমস্ত শিল্পোন্নত দেশ আছে, যেমন পুঁজিবাদী মডেলের যে সমস্ত দেশ বা সমাজতান্ত্রিক মডেলের যে সমস্ত দেশ এগুলি যারা চেষ্টা করেছে তাদের মধ্যে নারী বিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে পার্থক্য আছে, আবার অনেকগুলো ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি আছেইউরোপের ক্ষেত্রে কিংবা অন্য ক্ষেত্রে আমরা দেখি পুঁজিবাদী বিকাশ যখন হয়, নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি তখন পর্যন্ত বৈষম্যমূলক ছিল, নারীর ভোটাধিকার ছিল না, আইনগতভাবে তাদের অস্তিত্বই স্বীকার করা হত না, নারীর ভোটাধিকারও আসছে অনেক পরেশিল্প বিপ্লবকালে নারীর শ্রম কীভাবে অনেক কম মজুরিতে নেয়া হত সেগুলি আমরা মার্কসের ক্যাপিটাল-এ বিস্তৃতভাবে পাই
সোভিয়েত বিপ্লব বিশ্বব্যাপী এমনকি পুঁজিবাদী দেশগুলিতেও নারীর অধস্তন অবস্থানকে পরিবর্তন করে মানুষের অবস্থানে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেরুশ বিপ্লব হওয়ার পরপরই তারা প্রথম দিকেই যে সমস্ত আইনগুলি প্রণয়ন করে সেগুলির মধ্যে নারীর সামাজিক, অর্থনৈতিক স্বীকৃতি, তার অবস্থান, তার ভোটাধিকার নিশ্চিতকরণ ছিল অন্যতম১৯১৭ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন এগুলি করে তখন কিন্তু ইউরোপের দুএকটি দেশ ব্যতীত কোন দেশেই নারীর ভোটাধিকার ছিল না, যুক্তরাষ্ট্রেও নাসোভিয়েত ইউনিয়নের অগ্রগতির প্রভাবে ইউরোপের দেশগুলিতে আস্তে আস্তে নারীর ভোটাধিকারসহ অন্যান্য দাবীগুলো মেনে নেয়সম্পত্তির মালিকানা তো ছিলই না তাদের যে সম্পত্তি অর্জনের যোগ্যতা বা অধিকার আছে সেটা স্বীকারই করা হতো না ইউরোপের দেশগুলিতে, উত্তর আমেরিকায়রুশ বিপ্লবের প্রভাবে এগুলো আস্তে আস্তে আসতে থাকে এবং চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকের মধ্যে মোটামুটিভাবে তুলনায় নারীর অবস্থানের অনেক অগ্রগতি হয়দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে চীন বিপ্লব এটাতে আরও ভূমিকা পালন করেচীন বিপ্লব, ভিয়েতনাম বিপ্লব এ সমস্ত বিপ্লবের মধ্য দিয়ে দেখা যায় ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকাসহ অন্যান্য দেশগুলিতে নারী প্রশ্ন অনেক জোরদার হয়পাশাপাশি যেটা হয় এসমস্ত দেশে নারী আন্দোলন, সত্তর দশকের নারী আন্দোলনের প্রভাবে নারীর সম্পত্তি, নারীর কর্মসংস্থান, ভোটাধিকার এবং নারীর নিরাপত্তা এ সমস্ত বিষয় অধিকতর গুরুত্ব পেতে থাকেসেটার কারণেই এ সমস্ত দেশে এখন নারী-পুরুষের যে বৈষম্য, কর্মসংস্থানে বা মজুরিতে অনেকখানি অগ্রগতি হয়েছেপুঁজিবাদী বৈষম্য থেকে নারীর রেহাই পাওয়ারতো উপায় নাই কিন্তু তা সত্ত্বেও স্পেসটা অনেক বাড়ছে, তদের ভয়েসটা অনেক বাড়ছে, তাদের ভিজিবিলিটি অনেক বাড়ছে এবং তাদের লড়াইটা এখন পর্যন্ত অব্যাহত আছেএই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে, লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে ইউরোপের কোনো কোনো দেশ অনেকখানি অগ্রগতি অর্জন করেছে বিশেষত যেগুলিকে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশ বলা হয়, নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ড এই সমস্ত দেশে তাদের নারীদের অবস্থা অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক ভালোতাদের নিরাপত্তা, তাদের কর্মসংস্থান, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা সেটা তুলনামূলকভাবে বেশি অন্যান্য অঞ্চলের নারীদের এই লড়াইটা অব্যাহত রাখতে হচ্ছেসে তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে নারীদের নিরাপত্তাহীনতা, দারিদ্র, বৈষম্য আরও বেশি
মুক্তচিন্তাঃ যদি মানুষ হিসেবে বিকাশের প্রশ্ন আসে বা চূড়ান্ত অর্থে নারী মুক্তির প্রশ্ন আসে তাহলে এমনকি ব্যবস্থা বা কর্মসূচী নেয়া যেতে পারে যা নারীদের সত্যিকার অর্থে মুক্তি দিতে পারে বলে আপনি মনে করেন? 
আনু মুহাম্মদঃ নারী মুক্তি বা নারীর সমানাধিকার এটার সাথে তো অনেকগুলো প্রশ্ন জড়িত থাকেকারণ নারীতো কোনো হোমোজিনিয়াস বা সমরূপ চরিত্র না মানে নারী বিভিন্ন শ্রেণীতে বসবাস করে, নারী বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে আছে, বিভিন্ন ভাষার মধ্যে আছে, বিভিন্ন জাতির মধ্যে আছেসুতরাং আমরা যদি বলি যে, নারী পুরুষের সমানাধিকার তখন যে প্রশ্নটা খুবই সঙ্গত যে, কোন নারীর সাথে কোন পুরুষের সমানাধিকার? একটা শ্রেণীর মধ্যে নারী পুরুষের সমানাধিকার তো নারী পুরুষের সমানাধিকার নিশ্চিত করতে পারে নাকারণ নারী পুরুষের সমানাধিকার আসতে গেলে বিভিন্ন শ্রেণী বৈষম্যটাও তো আসেএখন গার্মেন্টস মালিক যদি নারী হয় এবং গার্মেন্টস শ্রমিকও যদি নারী হয় তাহলে তাদের এই বৈষম্য দূর করবার সংগ্রাম তো শ্রেণী সংগ্রামের সঙ্গে সম্পর্কিতনারী হওয়ার কারণেই তো তাদের মধ্যে কোনো ঐক্য আসবে নাআবার জাতিগতভাবে আমরা যখন বৈষম্য দেখি, সংঘাত দেখি তখন দেখি নারীর উপরই নির্যাতনটা সবচেয়ে বেশিধর্মীয়ভাবে যখন নিপীড়ন হয় নারীর উপর তখন নির্যাতনটা সবচেয়ে বেশি আসেসেই কারণে নারী মুক্তির প্রশ্নের সাথে সামাজিক প্রশ্ন, রাজনৈতিক প্রশ্ন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন নীতিমালা, উন্নয়ন দর্শন অনেকগুলি প্রশ্ন জড়িত থাকেসে কারণে সামগ্রিকভাবে একটা সমাজের মুক্তির লড়াই থেকে নারী মুক্তিকে বিচ্ছিন্ন করা যায় নাআবার মুক্তির যে লড়াই সে লড়াইটা যদি নারী প্রশ্নকে যথাযথভাবে ধারণ করতে না পারে তাহলে সেই সমাজের মুক্তির লড়াইটা বেশিদূর অগ্রসর হতে পারে নাযেমন আমাদের দেশে যারা বিপ্লবী রাজনীতির মধ্যে আছেন, বাম রাজনীতি করেন সেই বাম রাজনীতি কিন্তু এখন পর্যন্ত আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে আমি বলতে চাই বাম রাজনীতির মধ্যেও পুরুষতান্ত্রিকতা যথেষ্ঠ শক্তিশালীভাবে আছেতার কারণে এ আন্দোলনের মধ্যে আমরা দেখতে পাই ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্য থেকে যখন ছাত্রীদের অংশগ্রহণ যতটা শক্তিশালীভাবে থাকে, যতটা সম্ভাবনা দেখা দেয়, পরবর্তীকালে তারা নেতৃত্ব পর্যায়ে আসতে পারে নাএর পেছনে দুইটা বাধা সামাজিকভাবে আছেসমাজে একটা ছেলেও যখন বিপ্লবী রাজনীতিতে আসতে চায় সামাজিক প্রতিবন্ধকতা তাকেও আটকে রাখেকিন্তু নারীকে রাখতে চায় আরও বেশি শক্তভাবেনারীর সেই বাধা অতিক্রম করে আসাটা আরও বেশি কঠিনএটা একটা বাঁধা কিন্তু বাম রাজনীতির মধ্যে যে পুরুষতান্ত্রিকতা সেটাও কিন্তু বড় ধরনের বাধা হয়সেজন্য সমাজের নারী মুক্তির লড়াইটা সামগ্রিকভাবে সামাজিক মুক্তির লড়াই, শ্রেণীসংগ্রাম কিংবা জাতিগত বা ধর্মীয় বা ভাষাগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে যে লড়াই সেই লড়াইগুলোর সাথে সরাসরি যুক্তএবং শ্রেণীসংগ্রাম ও বিপ্লবী লড়াইয়ের কথাও যদি বলি তাহলে সেটা নারী প্রশ্নটাকে কতটা যোগ্যতার সঙ্গে দক্ষতার সঙ্গে গ্রহণ করতে পারছে, পুরুষতান্ত্রিকতা থেকে কতটা মুক্ত করতে পারছে তার উপর এ লড়াইয়ের বিকাশটা নির্ভর করে
সর্বোপরি অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক-মতাদর্শিক মুক্তিই নারীকে সত্যিকার অর্থে মুক্তি দিতে পারবেযেমন আমরা দেখি যে সমস্ত দেশে বিপ্লবী পরিবর্তনের চেষ্টা হয়েছে যেমন সোভিয়েত ইউনিয়নে, চীনে সেই সমস্ত দেশে আমরা দেখি যে বিপ্লবী একটা সাফল্য আসার পরও বিপ্লবী শক্তি রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করার পরও কিছু কিছু বিষয়ে তাদের লড়াইটা অব্যাহত রাখতে হয়যেমন জাতিগত প্রশ্নের সমাধান কিংবা ভাষা প্রশ্নের সমাধান কিংবা সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে পরিবর্তন, ঠিক একই রকম নারী প্রশ্ননারী প্রশ্নের সমাধানটা একটা দীর্ঘমেয়াদী ব্যাপার কারণ এটা একেবারে ঘরের ভেতরের ব্যক্তির অন্তর্গত তার সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক মতাদর্শিক অবস্থানকে চ্যালেঞ্জ করেনারী যখন তার মুক্তির জন্য লড়াই করে তখন সেই লড়াইটা একেবারে ঘরের ভেতর থেকে মূল ধরে নাড়া দেয়সেটার সাথে আসে তার সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় অবস্থান, সেটার সাথে আসে সামগ্রিক সমাজের মধ্যে যে বিভিন্ন ধরনের বৈষম্য সেই বৈষম্যসেজন্য নারী মুক্তির লড়াইটা সকল দেশে বিপ্লবী মুক্তির লড়াইয়ের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়একদিকে আমরা দেখি যেমন বাংলাদেশের বিভিন্ন লড়াইয়ের ক্ষেত্রে বলতে পারি কিংবা ভিয়েতনাম, কোরিয়া, চিন, রাশিয়া, এলসালভাদর, নিকারাগুয়া, কিউবা এসমস্ত দেশের বিপ্লবী লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা থেকেও আমরা দেখি নারী যখন অগ্রসর হয় তখন সেই লড়াই কিন্তু অনেক বেশি বেগবান হয় এবং সেই লড়াইটা গুণগতভাবে বা অন্তর্গতভাবে অনেক শক্তিশালী হয়কারণ নারীর অংশগ্রহণ একেবারে পরিবারকেও পরিবর্তনের তাগিদ দেয়, পরিবারের অবস্থানের পরিবর্তনের তাগিদ দেয়বিবাহ, সন্তান, সন্তানের উপর কর্তৃত্ব, সম্পত্তির উপর মালিকানা, মানুষ হিসেবে তার স্বীকৃতি সমস্ত কিছুকে এমনভাবে নিয়ে আসে যে, এই লড়াই একজন পুরুষকেও বিপ্লবীকরণ করেনারী যত অগ্রসর হয় পুরুষও তত বিপ্লবী হওয়ার একটা স্পেস পায়নিজেকে পরিবর্তন করার, নিজেকে মুক্ত করার মানে পুরুষতান্ত্রিকতা থেকে মুক্ত করার একটা সুযোগ সেখানে তৈরী হয়সেজন্য বিষয়টাকে দেখতে হবে এরকম নারী মুক্তির লড়াইটা সব সময় বা নারী প্রশ্নটা শুধুমাত্র নারীর বিষয় নাএটা পুরুষের জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়আমাদের সমাজে আমরা অনেক সময় দেখি যে, নারী মুক্তি বা নারীর সমানাধিকারের প্রশ্ন যখনই আনা হয় সাধারণভাবে পুরুষ একটা প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়িয়ে থেকে যায়খুবই সহজভাবে যদি বিষয়টাকে বিশ্লেষণ করা হয় যেমন নারী যদি নিরাপদে থাকে, নারী যদি সম্মানের সাথে থাকে, নারী যদি তার অভিজ্ঞতাকে বা মেধাকে যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারে এটাতে শুধুমাত্র যে নারীর জীবন স্বচ্ছন্দ বা উন্নত হয় তা না একজন পুরুষের জীবনও স্বচ্ছন্দ হয়, নিরাপদ হয়কারণ পিতা হিসেবে, ভাই হিসেবে, স্বামী হিসেবে, বন্ধু হিসেবে, সহযোদ্ধা হিসেবে, সহকর্মী হিসেবে একজন পুরুষও কিন্তু তখন অনেক স্বচ্ছন্দ জীবন যাপন করতে পারেএই উপলব্ধিটা পুরুষের মধ্যে এলে অনেক ধরনের জটিলতা, সমাজের মধ্যে যেটা আছে, থাকবে না, পুরুষ এবং নারী সকলের মুক্তির লড়াইয়ে সামিল হতে পারবেসেই ক্ষেত্রে ধর্মীয় যে সমস্ত শক্তি আছে অনেক সময় আমাদের মনে হয় যে, নারীর বিরুদ্ধে তাদের যে প্রতিরোধ এটা বোধহয় ধর্মীয় প্রতিরোধ এটা আসলে তা নাসম্পত্তির উত্তরাধিকার নিয়ে ধর্মীয় শক্তিগুলো যখন প্রতিরোধ তৈরি করে এটার পক্ষে কিন্তু সাধারণভাবে যে পুরুষেরা ধর্মীয় শক্তির অংশ না তাদেরও কিন্তু একটা সমর্থন থাকে  সম্পত্তির উত্তরাধিকার, নারীর বিবাহ, বিবাহ-বিচ্ছেদ, সন্তানের উপর কর্তৃত্ব, সমানাধিকার সেটার বিরোধিতা কিন্তু সাধারণ পুরুষের মধ্যেও আছেএমনকি অনেক বামপন্থি পুরুষও পাওয়া যাবে সে হয়তো ভয়ে আতঙ্কিত যে তার অবস্থান চলে যাচ্ছে বা সে কর্তৃত্বহীন হয়ে পড়ছেপুরুষতান্ত্রিকতা কোনো না কোনোভাবে তার মধ্যে কাজ করে কিন্তু সহজভাবে জিনিসগুলিকে আমরা দেখি যে নারী মুক্তি নারীর বিকাশ আসলে পুরুষের মুক্তি বা মানুষের মুক্তির পূর্ব শর্তসেইভাবে দেখলে শুধুমাত্র বিদ্যমান সামাজিক সম্পর্কের মধ্যে না বিপ্লবী আন্দোলনের মধ্যেও অনেক নতুন মাত্রা যোগ হবে এবং তা প্রযোজনীয় শক্তি অর্জন করতে সক্ষম হবে
মুক্তচিন্তাঃ আপনাকে ধন্যবাদ
আনু মুহাম্মদঃ তোমাদেরকেও ধন্যবাদ

No comments

আমাদের ঠিকানা

রংপুর।, Bangladesh
বিজ্ঞানচেতনা পরিষদ, টাউন হল চত্বর, রংপুর। মোবাইলঃ ০১৭১৯৪৬৩৫৪১, ০৭১৪৬০৭০৬৩৪, ০১৭৩৮২৮০২০১। E-mail: muktochintabcp@gmail.com
Powered by Blogger.