জলবায়ু বিপর্যয় ঃ ইতিহাসের দিক থেকে / শাহ্ ফরিদ
নানা চড়াই- উৎড়াই, উল্লমফন অবনমন ও প্রাকৃতিক নির্বাচন ক্রিয়ার মাধ্যমে প্রকৃতিজগতে মানুষ প্রজাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথমে বৃক্ষাচারী পরে দলবদ্ধ সমতলবাসী ক্রমেই পাথর ঘষামাজা হাতিয়ার তৈরী ইত্যাদি কর্মকান্ডের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলে মানব প্রজাতি। এর পর আগুনের আবিষ্কারে আরো এক ধাপ এগিয়ে গেল মানুষ। বৃদ্ধি পেল সংখ্যা। শিকারীজীবী মানুষ শিখল পশুপালন, কৃষিকর্ম। লাঙ্গলে পাথরের ফলার জায়গায় ধীরে ধীরে স্থাপিত হল লৌহ। গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজে মানুষের মাঝে ঘটল শ্রেণি বিভাজন। ক্রমেই দাস প্রথার উদ্ভব নানা লড়াই সংগ্রামের ভেতর দিয়ে এই প্রথা ভেঙ্গে তৈরি হল সামন্ত প্রথা ইহাও টীকল না, আসলো বুর্জোয়া ব্যবস্থা। ইহাই সংক্ষেপে মানুষের ইতিহাস। মানুষের সভ্য হয়ে যাওয়ার ইতিহাস থেকে দেখলে জলবায়ু বিপর্যয়ের শুরু ও অদ্যাবধির কারণ গুলি সম্পর্কে সহজেই স্পষ্ট হওয়া যায়। দাস ও সামন্ত ব্যবস্থায় দাস মালিক ও ভূ স্বামীরা দাস ও ভূমিদাসদের দিয়ে বনজঙ্গল সাফ করিয়েছে কৃষিকর্মের জন্য তাতে প্রকৃতির বাস্তু-ব্যবস্থা বিশেষ ক্ষতিগ্রস্থ না হলেও তারা মানুষকে প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। প্রকৃতির ওপর মানুষের কঠোর হস্তক্ষেপের মূল সূত্রগুলোর উৎপত্তি ঐ সময়েই। যে মানুষ প্রকৃতির মাঝেই ছিল তারাই প্রকৃতির বিপক্ষে দাঁড়াল। খ্রিষ্টিয় পঞ্চাদশ শতকে ইয়োরোপে শিল্প বিপ্লব ঘটল। তারা আরো মার মুখি হয়ে উঠল। অবিরাম গতিতে উৎপাদিত হল পণ্য সম্ভার। তাদের নিজ নিজ দেশের চাহিদা পুরণ হল কিন্তু অতি উৎপাদনের মহামারী আর থামলো না। তারা বাজার অনুসন্ধান শুরু করল। শুরু হল তাদের দিগি¦ক ছুটাছুটি। কোথাও নিয়ে গেল রক্তপাতের জন্য তরবারী আর কোথাও বাইবেল। তৈরী হল উপনিবেশ। উপনিবেশিত দেশ গুলির মানুষের মাঝে তারা কৃত্রিম চাহিদা তৈরী করে মালামাল সাপ্লাই করতে থাকলো। আর সেখানকার প্রাণ প্রকৃতি পরিবেশ ধ্বংস করে কাঁচামাল নিয়ে যেতে থাকলো। আর যারা উপনিবেশ তৈরী করতে পারে নাই তারা আয়োজন করল পৃথিবী ব্যাপী যুদ্ধের। এভাবেই ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে প্রথম মহাযুদ্ধ ও ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ ঘটে গেল। দুনিয়ায় বড় ধরণের তছনছ হয়ে গেল। এই যুদ্ধ গুলিতে ব্যাপক ধ্বংস ও অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হল উপনিবেশিক শক্তিগুলি। ফলে উপনিবেশিত দেশ গুলি ক্রমেই স্বাধীন হতে শুরু করল। কিন্তু ধনিক শ্রেণীর রাষ্ট্রগুলি ভাগবাটোয়ারাকারী একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান তৈরী করল জাতিসংঘ নামে। যার মাধ্যমে ধনিকশ্রেণীর রাষ্ট্রগুলি পৃথিবীর অন্যান্য দরিদ্র দেশগুলি (যাদের দারিদ্রতার জন্য তারা দায়ী) মানুষের ভাগ্য নিয়ে সহজেই গেম দিতে পারে। দারিদ্র দেশগুলি পড়ে গেল নতুন এক ফাঁদে। এই ফাঁদ নয়া উপনিবেশের ফাঁদ। এই ফাঁদ আরো জটিল জাল বুনেছে সারা পৃথিবীময়। দুষণ করে চলছে অতিমাত্রায়। আজকের সময়ে এসে আমরা কি দেখছি? অতীতের শিল্পোন্নত দেশগুলির বাজার কাড়াকাড়ি, যুদ্ধ, প্রকৃতি বিনষ্ট এই গুলির ফলাফল আজকের জলবায়ু বিপর্যয়। যে বিজ্ঞান রপ্ত করে মানুষ কাজে লাগিয়েছে প্রকৃতির বিরুদ্ধে, সেই প্রকৃতি বিচারের রায় লিখিত হইতেছে বিজ্ঞানীদের হাতেই। তারা বলতেছে, অপরাধী মানুষ ও তাদের সভ্যতা। এইটুকু বলেই খালাস! কোন মানুষ? কাদের সভ্যতা? এই গুলি কে বলবে? ওজোন স্তর
ছিদ্র হইতেছে, অতিবেগুনী রশ্মি নেমে আসবে বলে চারিদিকে গুনগুন ধ্বনি উঠেছে। কিন্তু ওজোন স্তর ক্ষয়ের প্রধান উপাদান কার্বন ডাই-অক্সাইড বায়ুমন্ডলে কারা বেশি পরিমাণ নির্গমন করিতেছে, আফ্রিকার কালা আদমী নাকি দক্ষিণ এশিয়ার হতভাগ্যরা। উন্নত দেশগুলি নিঃসরিত গ্রিন হাউস গ্যাসে পৃথিবী গরম হয়ে গেল, বরফ গলে জল হইতেছে। সমুদ্র উপকূলবর্তী দেশগুলি জলমগ্ন হবে। কি নির্মম ব্যাপার! অপরাধী কারা আর সাজা ভোগ করবে কারা। এককালে যে দেশগুলিকে সমাজতন্ত্র কায়েমের লক্ষে বিপ্লব হয়েছিল বলে আমরা জানি, তারাও এই অপরাধ থেকে নিস্তার পাবে না। কারণ ব্যাপারটা নিযে তারা সামান্যও ভাবিত না হয়ে বুর্জোয়া রাফ উৎপাদন পদ্ধতির সামান্য উন্নয়ন (পরিবেশ বান্ধব) না ঘটিয়ে আঁকড়ে ধরে প্রতিযোগিতায় নেমেছিল এবং অদ্যাবধী আছে। অবস্থা যখন এইমত তখন ধনী শিল্পোন্নত দেশ গুলি নানা অজুহাত খুঁজতে থাকলো তাদের অপরাধ ও নোংরামিকে জায়েজ করতে। অপরাধী, কম অপরাধী ও নিরপরাধ সকলকে এক সারিতে বসিয়ে অপরাধী সাব্যস্ত করার প্রক্রিয়া শুরু হল। ব্যাপারটা এ রকম যে, কতিপয় ভদ্রলোক একটি সুন্দর বিকালে হাসি ঠাট্টা করতে করতে হাঁটছিলো। হঠাৎ বেখেয়াল বশতঃ তাঁরা সবাই একটি নোংরা পানির গর্তে পড়ে; গেলেন। তখন সকলে মুখ চাওয়া চাওয়ি করে বিকল্প কোন উপায় খুঁজে না পেয়ে ফেরত আসছিলেন। পথের ধারে কাজ করতে ছিলো কিছু সাধারণ মানুষ। তারা ভদ্রলোকদের জিজ্ঞাস করল, বাবুরা নোংরা পানি গায়ে যে? তখন তেনারা উত্তর দিলেন আরে এরা যে দেখছি কিছুই জানে না। সামনে একটু আগাও দেখবা কি সুন্দর মিষ্টি পানির হ্রদ। আমরা লোভ সামলাতে না পেরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। তোমরাও খুব মজা পাবে। অমনি সাধারনেরা গর্তে ঝাঁপিয়ে পড়লো এবং পানির স্বাদ বুঝতে পারল। এর পর ভদ্র লোকেরা বললেন কেমন? আর কাউকে বলবে?
আন্তর্জাতিক সভা সমিতি বসতে শুরু করলো জলবায়ু বিপর্যয় নিয়ে। ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে জাতিসংঘ ব্রাজিলে আয়োজন করলো ধরিত্রী সম্মেলন। সেখানে শিল্পোন্নত দেশগুলি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ দেশগুলি জন্য ফান্ড গঠনের অঙ্গীকার করল। অধিক মাত্রায় গ্রিণ হাউস গ্যাস নির্গমনকারী শিল্পগুলি বর্জন না করে তারা ফান্ড গঠন করবে এতে করে তারা ঐ শিল্পগুলির মাধ্যমে নিয়মিত দুষণের অধিকার পাবে। ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে ৩৭ টি শিল্পোন্নত দেশ পৃথিবী গরম করার দায় স্বীকার করল এবং পৃথিবীকে শীতল করার একটি কৌশল গ্রহণ করল। কৌশলটি এ রকম, উক্ত দেশ গুলি নির্দিষ্ট পরিমাণ গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন কমাবে। যদি তারা সেই পরিমাণ কমাতেও না পারে তবে বাকি অংশ টুকু কমাবে অনুন্নত দেশগুলি। এত অনুন্নত দেশগুলির যে খরচা হবে ঐ দেশ গুলি তা বহন করবে। এই হাস্যকর কৌশলটিকে তেনারা মিটিগেশন বলিতেছেন। ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দের ১১ ডিসেম্বর গৃহীত হয় কিওটো চুক্তি। এই চুক্তির বিশেষ একটি দিক হল ইমিশন ট্রেডিং বা কার্বন ট্রেডিং। সেটা হচ্ছে প্রত্যেক দেশ নির্দিষ্ট পরিমাণ গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমনের সুবিধা পাবে। যারা ঐ মাত্রায় নির্গমন করে না তারা তাদের নির্গমন সুবিধা অন্য দেশের কাছে বিক্রি করতে পারবে। যেমন বাংলাদেশ কম মাত্রায় গ্রিণ হাউস গ্যাস নির্গমন করে অতএব তারা তাদের বরাদ্দমাত্রা
অন্য দেশের কাছে বিক্রি করতে পারবে। এই কৌশল বাস্তবায়িত হলে দুষণের মাত্রা কমবে নাকি বাড়বে সেটা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার নাই। কিওটো চুক্তির আরো একটি দিক হল অ্যাডাপটেশন ফান্ড। এর মানে হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্থ দেশগুলির জনগনকে পরিবর্তিত পরিবেশের সাথে বসবাস। জলবায়ু বিপর্যয়ের ফলে বন্যা, খরা, লবনাক্ততা বাড়বে ফলে উক্ত পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ার মত কৃষি, শিল্প ও অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রয়োজনীয় অর্থ ঋণ হিসেবে পাবে দায়ী দেশগুলি কাছ থেকে। এই ভাবে সভা, সমিতি, সম্মেলন হচ্ছে আর গৃহীত হচ্ছে এই কৌশল গুলি এবং ক্ষতিগ্রস্থ দেশ গুলিতে তৈরী হইতেছে এজেন্ট। যারা ঐ কূ কৌশল গুলি ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের উপর গছিয়ে দিয়ে নিজেরা কোটিপতি হওয়ার ধান্দায় লিপ্ত। পরিবেশ অপরাধীরা এভাবে সভা, সমিতি করে ফান্ড গঠন করতেই থাকিবে আর ক্ষতিগ্রস্তদেশের সরকার গুলি মেরুদন্ডহীন ভিক্ষুকের মত দাঁড়িয়ে নজর দিবে ঝুলির দিকেই। এদিকে জলবায়ু বিপর্যয়রোধ দীর্ঘায়িত হতেই থাকিবে।
চাই ব্যবস্থার পরিবর্তন। ব্যবস্থার পরিবর্তন ছাড়া জলবায়ু বিপর্যয় রোধ সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন ক্ষতিগ্রস্থ দেশগুলির জনগণের সংগ্রামী গণ ঐক্য ও গণ প্রতিরোধ। অন্যথা অবস্থা হবে কফিল আহম্মদের গানের মতই “ বৈঠক বসে গোল বৈঠক বসে বৃথা সংঘ বসে জাতিসংঘ বসে ”
No comments