অবরুদ্ধ শহীদ মিনার, অবরুদ্ধ ভাস্কর্য, অবরুদ্ধ আমরা / স্বাপন বর্মণ
১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জা এক ঘোষণা বলে দেশে সামরিক শাসন জারি করেন। পরবর্তীতে জেনারেল আইয়ুব খাঁন প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জাকে ক্ষমতা চ্যুত করে ২৭ অক্টোবর ১৯৫৮ নিজেকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেন একই সাথে তিনি প্রধান সেনাপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রসাশকের ক্ষমতায়ও বহাল থাকেন। সে সময় দেশে গণতন্ত্র, আইন পরিষদ, কেন্দ্রিয় ও প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা বাতিল করা হয়। রাজনৈতিক দলগুলো নিষিদ্ধ করে সকল রাজনৈতিক কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয় এ সময় শহীদ মিনার তৈরির কাজ ও বন্ধ হয়ে যায়। তা সত্ত্বেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশকিছু সংগ্রামী অকুতোভয় ছাত্র ও পেশাজীবি মানুষ একুশে ফেব্রুয়ারিতে অসম্পন্ন শহীদ মিনারে ফুল দিয়েছে, সভা করেছে ও শপথ নিয়ে তৎকালীন শাসক গোষ্ঠীর অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে। একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধেও পাকবাহিনী শহীদ মিনারটি ভেঙ্গে দেয় এবং সেখানে “মসজিদ” কথাটি লিখে রাখে কিন্তু এদেশের মানুষ তা গ্রহণ করেনি। দেশ স্বাধীনের পর শহীদ মিনার পুনরায় নির্মাণ করা হয়। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় এভাবেই শহীদ মিনার হয়ে ওঠে দেশের অগণতান্ত্রিক নিপীড়নকারী শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের তীর্থ ভূমি। আর তাই অগণতান্ত্রিক , নিপীড়নকারী মহল বরাবরই চাইবে শহীদ মিনারের পরিধি যত ছোট করা যায়, যতটা অবরুদ্ধ করা যায় এর বিস্তার। কেননা শহীদ মিনার চত্ত্বর যত ছোট হবে অধিকার আদায়ী অন্যায়ের প্রতিবাদ কারী শক্তিগুলো তত অসংগঠন ও দূর্বল হয়ে পড়বে। আর সেই বিশেষ মহল তার চাবুক খুব সহজেই সাধারণ নিরীহ ছাত্র-জনতার উপর চালাতে পারবে। সরকার হলে গণতন্ত্র নস্যাৎ করে জনগনের সম্পদ লুটপাট করে দেশের তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ বিদেশে পাচার করে। আর কলেজ বা ভার্সিটির ক্ষেত্রে বিভিন্ন খাতে অতিরিক্ত ফি (যেমন ফরম ফিলাপ ফি, কেন্দ্র ফি, সেমিনার ফি, পরিবহন ফি, ইত্যাদি) আদায় করে।
উত্তর বঙ্গের অন্যতম শীর্ষ বিদ্যাপীঠ কারমাইকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ সেই ভূমিকাই নিচ্ছেন কি না যখন দেখতে পাই, ১৯৭২-৭৩ সালে কলেজের প্রশাসনিক ভবনের সামনে লিচুতলায় নির্মিত শহীদ মিনার চত্ত্বরটি সীমানা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। কেন এই সীমানা প্রাচীর? কেন অবরুদ্ধ করা হলো শহীদ মিনার চত্ত্বর?
আবার সরকারি উদ্যোগের বাইরে একমাত্র কলেজ হিসাবে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে কারমাইকেল কলেজের কবিতা সংগঠন “শব্দকন্ঠ” একটি ভাস্কর্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়। এই উদ্যোগের সাথে শিবির ছাড়া কারমাইকেল কলেজের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল ছাত্র সংগঠন ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারী স্বতঃস্ফূর্তভাবে যুক্ত হয়ে যায়। ১৯৯১ সালের ২৮ শে জানুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে ভাস্কর্য নির্মাণের অনুমতি চেয়ে দরখাস্ত করা হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় নীতিগতভাবে এই কাজে সম্মতি জানায় এবং গণপূর্ত বিভাগের অনুমতি নেয়ার পরামর্শ দেয়। সেখানেও আবেদন করা হলে ১৯৯১ সালের ৩০শে এপ্রিল গণপূর্ত বিভাগ হতে একটি চিঠি কলেজের অধ্যক্ষ বরাবর আসে। কারমাইকেল কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. রেজাউল হক কে আহ্বায়ক করে ভাস্কর্য নির্মাণ কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির তত্ত্বাবধানে ভাস্কর অনিক রেজার সাথে চুক্তি করা হয়। পূর্ণ উদ্যমে শুরু হয় অর্থ সংগ্রহের কাজ। ছাত্র-শিক্ষক ও রংপুরবাসী মুক্তিযুদ্ধের এই স্মারক ভাস্কর্য নির্মাণের জন্য উৎসাহ ভরে অর্থপ্রদান করে। ভাষা সৈনিক আ ন ম গাজিউল হক ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ হাসান আজিজুল হক ভাস্কর্যের ভিত্তি প্রস্তর উন্মোচন করেন। কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন তৎকালীন নির্মাণ কমিটির আহ্বায়ক ড. রেজাউল হক। শুরু হয় কাজ। ছাত্রনেতারাও শ্রমিকদের সাথে কাজে অংশগ্রহণ করেন। প্রাক্তন শিক্ষক ও ছাত্রনেতা এই ভাস্কর্য সমর্থক স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, আমাদের মধ্যে ভাস্কর্য নিয়ে এমনই আবেগ ছিল যে, বেলচা,কড়াই নিয়ে আমরা শ্রমিকের কাজ শুরু করে দিই। কংক্রিটের কড়াই বহন করে আমরা কাজে সহযোগিতা করেছি। রাতের পর রাত জেগে পাহারা দিয়েছি সকলে মিলে। মূল বেদীর নির্মাণ কাজ খুব দ্রুত শেষ হয়। কিন্তু ১৯৯২ সালে ২৯ মার্চ স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি, রাজাকারদের উত্তরসূরী ইসলামী ছাত্র শিবির ভিত্তিপ্রস্তরের উপর হামলা চালিয়ে ভেঙ্গে ফেলে। এরপর একাধিকবার নির্মাণ কাজ শুরুর উদ্যোগ নিলেও তাদের বাঁধার কারণে তা সম্ভব হয় নি। সর্বশেষ ১৯৯৯ সালে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বাধা উপেক্ষা করে ভাস্কর্যটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়। কারমাইকেল কলেজের ছাত্রসংগঠনগুলোসহ সর্বস্তরের মানুষ আশায় বুক বেধেছিল এবার হয়তো নির্মাণ কাজ সুষ্ঠু ভাবে শেষ হবে। কিন্তু এবারও আঘাত আসে আমাদের জাতীয় চেতনা সংগ্রামের প্রতীক ভাস্কর্য প্রজন্ম এর ভিত্তি মূলে। উল্লেখ্য যে, বহুল প্রতীক্ষিত ভাস্কর্যটিও নির্মাণ শেষে অবরুদ্ধ করা হয়।
যে তীর্থক্ষেত্রগুলো দেশের ক্রান্তিকালে ত্রাণকর্তারূপে আমাদের সামনে আর্বিভূত হয়েছে, তাদের বুকগুলোকে কেন সীমায়িত করা হলো? তবে কি কলেজ কর্তৃপক্ষ সেই ভূমিকাই নিচ্ছে যা ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান নিয়েছিল। এই প্রশ্ন আজ সাধারণ জনগণসহ কারমাইকেল কলেজের সকল ছাত্র-ছাত্রীবৃন্দের। এ বিষয়ে সদুত্তর পাওয়ার জন্য কলেজের অধ্যক্ষ্যের কাছে গেলে তিনি ছুটিতে থাকায় (০১/০৭/১২-০৪/০৭/১২) পরবর্তীতে বদলি সংক্রান্ত কাজে ব্যস্ত থাকায় তাঁর সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। এ বিষয়ে কলেজের প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন ছাত্র-ফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক রোকুনুজ্জামান রোকনের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন পূর্বে শহীদ মিনার চত্ত্বরে কোন অনুষ্ঠান করতে গেলে শহীদ মিনার সংলগ্ন লিচুতলায় সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক ছাত্র-সংগঠনের ছাত্র- শিবিরের বাধার মুখে তারা অনুষ্ঠান করতে পারেনি। ফলে তারা শহীদ মিনার চত্ত্বরটা সংরক্ষনের কথা বলেছিলেন কিন্তু প্রিন্সিপাল স্যার সংরক্ষনের নামে যে সীমানা প্রাচীর দিয়েছেন তাঁরা এটা সমর্থন করেন না এবং তাঁরা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন।
এর আগে আমাদের দীর্ঘ লড়াইয়ের মধ্যদিয়ে অর্জিত ভাস্কর্যটি নির্মাণের পরপরই ঘিরে দেয়া হয়। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন জাগে, কেন এই ঘিরে দেওয়ার প্রবণতা? আমাদের কথিত প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের নেতা, কর্মীরাও যখন এই ব্যাপারে চুপ থাকে তখন কিছু কথা থেকে যায়। ভাস্কর্য, শহীদ মিনার ঘিরে দেওয়ার কারণ যদি হয় মৌলবাদী ছাত্রসংগঠনকে জব্দ করা, নিরাপত্তাজনিত ব্যাপার, তাহলে বুঝতে হবে আমরা বোকার স্বর্গে বাস করছি, কিংবা প্রশ্ন উঠবে আমাদের ইতিহাস বোঝাপড়া নিয়ে। কেননা, কোন সংগঠন তা মৌলবাদী বা প্রগতিশীল যে ধরণের হোক না কেন তাদের সুনির্দিষ্ট কাঠামো থাকে, গঠনতন্ত্র থাকে, একটি মতাদর্শ থাকে। যদি কোন প্রতিষ্ঠান বা কোন মহল তাদেরকে জব্দ করতে চায় তাহলে তা অবশ্যই করতে হবে সাংগঠনিকভাবে মতাদর্শিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে।
গণবুদ্ধিজীবী সমাজের আবেগ অনুভূতির ভিত্তিতে যে ভাস্কর্য, শহীদ মিনারের জন্ম, সেই গণসমাজের আর ভাস্কর্য-শহীদ মিনারের মাঝে যদি দেয়াল তুলে দেয়া হয় তাহলে সেই ভাস্কর্য ও শহীদ মিনার কি তা থাকে? সেগুলো কি ইট বালুর স্তুপে পরিণত হয় না? জাগতিক লড়াইয়ের প্রতীকগুলো যদি গণচেতনা গণসংগ্রামের সাথে যুক্ত না হয় তাহলে মৌলবাদী রাজনীতি কিভাবে প্রতিরোধ হবে? নাকি যে সব লড়াইয়ের প্রকাশ হিসেবে ভাস্কর্য-শহীদ মিনারের জন্ম, সেই সব লড়াই শেষ হয়ে গেছে? যারা বর্তমানে অতীতের এইসব লড়াইয়ে সুবিধাভোগী তারা মনে করে লড়াই শেষ হয়েছে। কিন্তু আমরা যারা মনে করি, লড়াই শেষ হয় নি, তাঁরা অবশ্যই চাই আমাদের ধারাবাহিক লড়াইয়ে এইসব প্রতীক বারবার শক্তি যোগাবে। তাই প্রয়োজন ভাস্কর্য ও শহীদ মিনারকে ঘিরে রাখা দেয়াল অপসারণের সংগ্রাম শুরু করা, সামর্থ থাকলে ভেঙে ফেলা এবং শহীদ মিনার-ভাস্কর্যকে যথার্থই সবার করে তোলা বিশেষত যারা মনে করেন মুক্তির লড়াই এখনো শেষ হয়নি।
No comments